প্রত্যাবর্তনের অসাধারণ গল্প লিখে লাল দুর্গ জোকোভিচের
প্রথম দুই সেটই জিতে নিয়েছিলেন স্তেফানোস সিৎসিপাস। মনে হচ্ছিল টেনিসের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিনিধি সিৎসিপাসের হাতেই উঠবে এবারের ফ্রেঞ্চ ওপেন। কিন্তু নেটের ও পাশের মানুষটির নাম যে নোভাক জোকোভিচ। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে হার মেনে নেওয়া যে তাঁর রক্তে নেই।
শেষ পর্যন্ত টেনিসের ‘ভবিষ্যৎ’কে হারিয়ে জিতলেন বর্তমানই। প্রত্যাবর্তনের অসাধারণ গল্প লিখে ৬–৭ (৬/৮), ২–৬, ৬–৩, ৬–২, ৬–৪ গেমে সিৎসিপাসকে হারিয়ে জিতে নিলেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফ্রেঞ্চ ওপেন ও ১৯তম গ্র্যান্ড স্লাম।
তাতে ইতিহাসও হলো। রয় এমারসন ও রড লেভারের পর ইতিহাসের মাত্র তৃতীয় পুরুষ খেলোয়াড় হিসেবে সবগুলো গ্র্যান্ড স্লাম একাধিকবার জেতা হয়ে গেল বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড়ের। মোট গ্র্যান্ড স্লাম জয়ে রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদালের ২০ গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ড ছোঁয়ারও নিশ্বাস দূরত্বে উঠে এসেছেন ৩৪ বছর বয়সী জোকোভিচ।
ফিরে আসার এমন গল্প শুনলে যেমন ধ্রুপদী টেনিসের কথা কল্পনায় আসে, তেমন দারুণ কিছু দেখা যায়নি জোকোভিচের র্যাকেটে। অবশ্য ৪৮ ঘন্টাও হয়নি, সেমিফাইনালে রাফায়েল নাদালের বিপক্ষে চোখধাঁধানো এক ম্যাচ জিতে এসেছেন জোকোভিচ। এর মধ্যে আজকের ফাইনাল মিলিয়ে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ৯ ঘন্টারও বেশি সময় ছিলেন কোর্টে। কিন্তু ক্লান্তিকে একপাশে রেখেও ঠিক সময়ে একেবারে নিখুঁত শট খেলার দুর্দান্ত ক্ষমতার আরেক প্রদর্শনী আজ প্যারিসের লাল মাটির কোর্টে রেখেছেন সার্বিয়ান তারকা।
তাতে ১৭ বছরের পুরোনো এক কীর্তিরও দেখা মিলল রোলা গাঁরোতে। ছেলেদের এককের ফাইনালে প্রথম দুই সেট হেরে যাওয়ার পরও ফিরে এসে শিরোপা জিতে নেওয়ার কীর্তি ফ্রেঞ্চ ওপেন সর্বশেষ দেখেছিল ২০০৪ সালে গাস্তন গাওদিও সেদিন প্রথম দুই সেট হেরে যাওয়ার পরও হারিয়ে দিয়েছিলেন গিয়ের্মো কোরিয়াকে (০-৬, ৩-৬, ৬-৪, ৬-১, ৮-৬)।
সিৎসিপাসের দীর্ঘশ্বাস আর কী! রানারআপের স্বীকৃতিসূচক রুপালি ট্রফিটা নেওয়ার সময় প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিলেন ২২ বছর বয়সী গ্রিক। তবে ম্যাচটা বুঝিয়ে দিয়ে গেল, তাঁকে কেন নতুন প্রজন্মের টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম সেরা মানা হয়। বুঝিয়ে দিয়ে গেল, তাঁর শিরোপামঞ্চে হাসিতে ভাসার সময় আজ হয়তো আসেনি, তবে খুব বেশি দূরেও নয়।
প্রথম দুই সেটের পর অবশ্য সময়টা আজই বলে মনে হচ্ছিল। প্রথম সেটে দুজনের প্রথম পাঁচ সার্ভিস গেমে কোনো অঘটন হয়নি, তবে সিৎসিপাসের ষষ্ঠ সার্ভিসে এসেই জোকোভিচ প্রথম ধাক্কা দেন। ব্রেক করেন সার্ভিস। কিন্তু সিৎসিপাসও পাল্টা দিতে সময় নেননি। পরের গেম অর্থাৎ জোকোভিচের ষষ্ঠ সার্ভিস তিনিও ব্রেক করেন। সেট গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে সিৎসিপাসই হাসলেন, টাইব্রেকার জিতলেন ৮-৬ ব্যবধানে।
সেই ছন্দটা ধরে রেখে দ্বিতীয় সেটের শুরুতেই আবার জোকোভিচকে ধাক্কা দেন সিৎসিপাস। জোকোভিচের সার্ভে শুরু দ্বিতীয় সেটের প্রথম গেমেই ব্রেক করেন গ্রিক তরুণ। চতুর্থ গেমে আবার। তাতে দ্বিতীয় সেট ৬-২ গেমে জিততে কষ্ট হলো না সিৎসিপাসের।
জোকোভিচকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল, ক্লান্তি তাঁর খেলায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রজার ফেদেরার তো চোটের কাছে হার মেনে তৃতীয় রাউন্ড শেষেই সরে গেছেন, নাদাল সেমিফাইনালে জোকোভিচের হাতেই বিদায় নিয়েছেন। সেদিন নাদালের বিপক্ষে প্রথম সেট হেরেও ঘুরে দাঁড়ানো জোকোভিচ আজ দুই সেট হারের পর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না, প্রশ্ন তখন সেটি।
জবাবটা জোকোভিচ দিলেন ক্যারিয়ারে এর আগে অনেকবার যেভাবে দিয়েছেন, সেভাবেই! তৃতীয় সেটে সিৎসিপাসের দ্বিতীয় সার্ভিস গেমেই ব্রেক করলেন ‘জোকার’, ফিরে আসার সেই শুরু। সেটটা জোকোভিচ জিতলেন ৬-৩ গেমে। সেটের শেষ গেমে জোকোভিচের ফোরহ্যান্ড উইনারই যেন ঘোষণা দিল, জোকোভিচ ফিরছেন!
তৃতীয় সেটের পর সিৎসিপাস একটু বিরতি নিয়েছিলেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে। কিন্তু হলো উল্টো। জোকোভিচ যেন তখন তেতে আছেন। চতুর্থ সেটের প্রথম দুই গেমেই সিৎসিপাসের সার্ভিস ব্রেক করলেন জোকোভিচ! সিৎসিপাস তখন আরও চাপে, ক্যারিয়ারে আরও ১৮বার এমন ফাইনাল জেতার অভিজ্ঞতা তখন জোকোভিচের হয়ে কথা বলছে। সেটে নিজের প্রথম দুই সার্ভিস গেমই ব্রেক হতে দেখা সিৎসিপাসের আর ফেরা হলো না। সেটটা সহজেই ৬-২ গেমে জিতলে জোকোভিচ। ম্যাচে তখন ২-২ সেটের সমতা!
জোকোভিচকে তখন আর ঠেকায় কে! শিরোপার ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন, সেমিফাইনালের ক্লান্তি তো প্রথম দুই সেটের পরই উধাও। অভিজ্ঞতাও তাঁর পক্ষে। পঞ্চম সেটে সিৎসিপাসের দ্বিতীয় সার্ভিস গেম ব্রেক করলেন জোকোভিচ, আগের দুই সেটের মতো এবারও আর জবাব জানা ছিল না সিৎসিপাসের। সেটটা ৬-৪ গেমে জিতে গেলেন জোকোভিচ, কিন্তু জিতে যে যাবেন, সেটা সম্ভবত আগেই বলা যাচ্ছিল!