ফেসবুকের সব বিনিয়োগকারী একজোট হলেও কি মার্ক জাকারবার্গকে সরাতে পারবেন

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মসে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে মার্ক জাকারবার্গেররয়টার্স ফাইল ছবি

টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি। পদত্যাগের ঘোষণায় তিনি বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের। কেউ সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁকে প্রভাবিত করেনি, বরং প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

এদিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনবিসিসহ প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বিনিয়োগকারীদের চাপের মুখে প্রতিষ্ঠান থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন ডরসি। বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য, একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সিইও হওয়ায় টুইটারে পূর্ণ মনোযোগী হতে পারছেন না তিনি। এতে নতুন নতুন উদ্ভাবনী সুবিধা যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না টুইটার। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদেরও একই ধরনের অভিযোগ।

গতকাল সোমবার থেকে এ খবর আমরা দেখছি। তবে মনে করুন, ফেসবুকের সব বিনিয়োগকারী যদি এককাট্টা হয়ে প্রতিষ্ঠানটির সিইও মার্ক জাকারবার্গকে হটানোর চেষ্টা করেন, তবে তাঁদের সে চেষ্টা কি সফল হবে? এ প্রশ্ন আসছে, কারণ ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার শেয়ার হোল্ডাররা যে সে চেষ্টা করেননি, তা কিন্তু নয়। তবে সফল যে হননি, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কেন সফল হননি, চলুন তা-ই জানার চেষ্টা করা যাক।

এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো, সব শেয়ারহোল্ডার চাইলে জাকারবার্গকে সরানো তো যাবেই। কারণ, স্বয়ং জাকারবার্গের শেয়ারও তখন হিসাবভুক্ত হবে। তবে জাকারবার্গ নিজে কেন নিজেকে সরাতে চাইবেন? তা যদি তিনি চানও, তবে দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিলেই তো পারেন। তাই জাকারবার্গ ছাড়া অন্য বিনিয়োগকারীদের কথা এখানে বিবেচনায় ধরা হলো।

সব বিনিয়োগকারীর ক্ষমতা এক নয়

পাবলিক কোম্পানির ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনলে সঙ্গে কিছু অধিকারও পান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে ভোটাধিকার। একটি শেয়ারের মালিকানা মানে একটি ভোট। তবে সে নিয়ম সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ফেসবুকের ক্ষেত্রে তো নয়ই।

আমরা বারবার ফেসবুক উল্লেখ করছি। তবে ফেসবুক এখন কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম। মূল প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে করা হয়েছে মেটা প্ল্যাটফর্মস ইনকরপোরেটেড। আর তাই শেয়ার মানে সেটা মেটার শেয়ার, ফেসবুকের নয়।

টুইটারের সিইও হিসেবে পদত্যাগ করেছেন জ্যাক ডরসি (বাঁয়ে), সে জায়গায় আসছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা পরাগ আগরওয়াল
এএফপি ও টুইটার

মেটার শেয়ার দুই ধরনের—‘ক্লাস এ’ ও ‘ক্লাস বি’। শেয়ার বাজারে মেটার ‘ক্লাস এ’ শেয়ারের বিকিকিনি করতে পারেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এমন প্রতিটি শেয়ারের জন্য শেয়ারহোল্ডাররা একটি করে ভোটাধিকার পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে ‘ক্লাস বি’ শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মার্ক জাকারবার্গসহ অল্প কিছু বিনিয়োগকারীর হাতে। শেয়ারবাজার থেকে চাইলেই এই শেয়ার কেনা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি ‘ক্লাস বি’ শেয়ারের বিপরীতে ১০টি ভোটাধিকার পেয়ে থাকেন বিনিয়োগকারী। অর্থাৎ ভোটাধিকারের বেলায় একটি ‘ক্লাস বি’ শেয়ার ১০টি ‘ক্লাস এ’ শেয়ারের সমান।

জাকারবার্গের একক সিদ্ধান্তই যে কারণে চূড়ান্ত

মেটার সহপ্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ। দীর্ঘদিন ধরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত। আবার সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডারও তিনি। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরে সমাপ্ত বছরের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী মেটায় তাঁর মোট শেয়ারের পরিমাণ ৩৯ কোটি ৮০ লাখ, যা সে সময় প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। তবে ‘ক্লাস বি’ শেয়ারের মালিকানার সুবাদে প্রতিষ্ঠানটির ভোটাধিকারের ৫৮ শতাংশ তাঁর নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ চাইলে একক সিদ্ধান্তে তিনি যা খুশি করতে পারেন মেটায়।

কোনো পাবলিক কোম্পানির সিইও নিয়োগের দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের ওপর। বিনিয়োগকারীরা যদি বর্তমান সিইওর ওপর নাখোশ হন, তবে তাঁরা পরিচালনা পর্ষদের কাছে আবেদন জানাতে পারেন। পরিচালনা পর্ষদ তখন ভোটাভুটির আয়োজন করতে পারে। ঘটনা যদি সে পর্যন্ত গড়ায়, তবে সিংহভাগ ভোটাধিকার বলে জাকারবার্গ একাই সে প্রস্তাবে ভেটো দিতে পারবেন। এ গেল একটা দিক।

জাকারবার্গ নিজেই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। পর্ষদের বাকি ৮ পরিচালকের মধ্যে তাঁর কাছের মানুষও তো রয়েছে। সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ গত মে মাসে জানায়, জাকারবার্গকে সরিয়ে স্বাধীন কাউকে সিইও পদে আনার দুটি প্রস্তাব পেয়েছিল মেটার পরিচালনা পর্ষদ। আবার বিশেষ শ্রেণির শেয়ার বাতিল করার প্রস্তাবও উঠেছিল। তবে জাকারবার্গের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ সেসব আবেদন সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে।

জাকারবার্গ নিজেই মেটার পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান
রয়টার্স ফাইল ছবি

আপাতদৃষ্টে মার্ক জাকারবার্গকে স্বৈরাচারী মনে হতে পারে। সেটা তিনি বটে। তবে প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে তা একদমই অপ্রয়োজনীয় বলার সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিষ্ঠানের কিসে ভালো হবে, তা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরই ভালো বলতে পারার কথা। আর সে কারণেই গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটসহ অনেক বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের রীতি চালু আছে। তবু নৈতিকতা এবং সমাজের বৃহত্তর ভালোর দিক বিবেচনায় এখনো জাকারবার্গদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার আবেদন বেশ জোরেশোরেই শোনা যায়।

যাহোক, নতুন বছর শুরুর পরও তারিখ লেখার সময় যেমন আগের সাল চলে আসে, মেটা লিখতে গিয়েও তেমনই বারবার ফেসবুক চলে আসছে। আশা করছি পাঠকেরা ব্যাপারটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।