ফেসবুকে সত্যের চেয়ে মিথ্যা দ্রুত ছড়ায় কেন
ফেসবুকে সত্য খবরের চেয়ে মিথ্যা তথ্যে ব্যবহারকারীর ‘এনগেজমেন্ট’ ছয় গুণ বেশি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুযায়ী, প্রকাশিতব্য এক গবেষণা প্রতিবেদনের ভাষ্য এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং ফ্রান্সের গ্রনব্লা আল্পস ইউনিভার্সিটির ওই গবেষক দল সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আড়াই হাজারের বেশি গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজ বিশ্লেষণ করেছে। তাঁরা দেখলেন, যে পেজগুলো থেকে বেশি ভুয়া তথ্য শেয়ার করা হয়, সেগুলোতে লাইক, শেয়ার ও কমেন্টের পরিমাণ অনেক বেশি।
আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ইন্টারনেট মেজারমেন্ট কনফারেন্সে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করার কথা আছে তাঁদের।
দ্য ভার্জকে ফেসবুকের এক মুখপাত্র অবশ্য বলেছেন, ওই গবেষণায় কেবল ফেসবুক পোস্টের ‘এনগেজমেন্ট’ দেখা হয়েছে, ‘রিচ’ আমলে নেওয়া হয়নি।
ফেসবুকে কোনো কনটেন্ট যত ব্যবহারকারী দেখেন, সেটিকে রিচ বলা হয়। আর যত ব্যবহারকারী সে কনটেন্টে ক্লিক, রিঅ্যাকশন, কমেন্ট, শেয়ার, সেভ করেন, সেটি হলো এনগেজমেন্ট।
অবশ্য পোস্টের রিচ-সংক্রান্ত তথ্য গবেষকদের দেয় না ফেসবুক। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির মিথ্যা তথ্যের প্রসার নিয়ে গবেষণা করতে চান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের তথ্য সংগ্রহ করতে হয় ‘ক্রাউডট্যাঙ্গল’ নামের একটি অনলাইন টুলের সাহায্যে। এই টুলটির মালিকও ফেসবুক।
গত আগস্টে ক্রাউডট্যাঙ্গল থেকে তথ্য সংগ্রহের সুযোগও কেড়ে নেওয়া হয় গবেষক দলটির কাছ থেকে। ফেসবুকের ভাষ্য হলো, তৃতীয় পক্ষের গবেষকদের এই তথ্য ব্যবহারের সুযোগ জারি রাখলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশনের (এফটিসি) দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করা হবে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির পর থেকে ফেসবুকের ওপর সে শর্ত আরোপ করা হয় বলে জানিয়েছে প্ল্যাটফর্মটি। তবে এফটিসি বলেছে, ফেসবুকের সে দাবি ঠিক নয়।
এনগেজমেন্টের বিচারে ফেসবুকের শীর্ষ পোস্টগুলোর নিয়মিত তালিকা প্রকাশ করতেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রযুক্তি কলামিস্ট কেভিন রুজ। ক্রাউডট্যাঙ্গল ব্যবহার করেই তথ্য সংগ্রহ করতেন তিনি। সেই তালিকাগুলোর শীর্ষে বরাবরই ভুয়া তথ্যযুক্ত পোস্ট থাকত।
ফেসবুকের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের ব্যাপক প্রসার যে গুরুতর সমস্যা, তা মানতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটি। গত মাসে প্রথমবারের মতো ‘স্বচ্ছতা প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছিল ফেসবুক। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) যে পোস্টগুলো সবচেয়ে বেশিবার দেখা হয়েছে, তার তালিকা ছিল সে প্রতিবেদনে। সেটি প্রকাশের দিন কয়েকের মধ্যেই নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম প্রান্তিকের জন্যও একই ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করেছিল ফেসবুক। তবে প্রকাশ করেনি। কারণ, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি দেখা পোস্টটি করোনার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
কেবল ফেসবুক নয়, টুইটারেও সত্যের চেয়ে মিথ্যার প্রসার কয়েক গুণ। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) একদল গবেষক টুইটারে শেয়ার হওয়া এক লাখের বেশি সংবাদ বিশ্লেষণ করে লিখলেন, ‘তথ্যের সব শ্রেণিতে সত্যের চেয়ে মিথ্যাচারের বিস্তার বেশি দ্রুত, বেশি গভীরে এবং বেশি বিস্তৃত।’
বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল সায়েন্সে প্রকাশিত সে গবেষণা প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা দ্রুত ছড়ানোর সম্ভাব্য কারণও লিখেছেন তাঁরা। সত্যের চেয়ে মিথ্যা খবর বেশি ‘নতুন’ এবং ‘নেতিবাচক’ বলে তা দ্রুত ছড়ায়।
মানুষ হিসেবে আমরা ইতিবাচক খবরের চেয়ে নেতিবাচক খবর ছড়াতে বেশি আগ্রহী। এটাকে নেতিবাচকতার প্রতি আমাদের পক্ষপাতও বলা যেতে পারে। আবার বিস্ময়কর এবং বিস্ময়কর নয়, এমন দুটি খবরের মধ্যে বিস্ময়করটি শেয়ার করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেশি। এই দুই মেলালে সত্যের চেয়ে মিথ্যা দ্রুত ছড়ানোর একটা কারণ পাওয়া যায়। তবে গবেষকেরা যেমনটা বলেছেন, এ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার, আরও তথ্য দরকার, আরও বিশ্লেষণ দরকার। তবেই হয়তো শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব হবে।