মাউস ছুঁয়ে ছিলাম ৩০ বছর আগে

মেকিনটোশ কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য িবজয়–এর ঘোষণা দিচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার (বঁায়ে)। ১৬ িডসেম্বর ১৯৮৮ l সংগৃহীত
মেকিনটোশ কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য িবজয়–এর ঘোষণা দিচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার (বঁায়ে)। ১৬ িডসেম্বর ১৯৮৮ l সংগৃহীত

২৮ এপ্রিল কম্পিউটারে হাত দিয়ে বাংলা প্রয়োগ করার লড়াই শুরু করার ৩০ বছর পার করে ৩১ বছরে পা ফেললাম। ১৯৮৭ সালের এই দিনে আমি একটি মেকিনটোশ কম্পিউটার স্পর্শ করে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের সূচনা করেছিলাম। সেই লড়াইটা এখনো অব্যাহত আছে। সেদিন যে মাউস ছুঁয়েছিলাম, সেই মাউস আজও আমাকে কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা করে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে র্যা ঙ্কিন স্ট্রিটের দৈনিক সংগ্রাম অফিস দখল করে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হওয়ার পর থেকে মুদ্রণপ্রযুক্তি বিষয়ে জানার বিষয়টি আমার আগ্রহের শীর্ষ স্থানে ঠাঁই পায়। পরে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে জীবিকার তাড়নায় সাংবাদিকতা থেকে ছিটকে পড়লেও ১৯৮১ সালে শেখ সাহেব বাজারের একটি প্রেস ভাড়া করে আবার সেই জগতে ফিরে আসি। ১৯৮৩ সালে ফিরে আসি পত্রিকা সম্পাদনার যুগে। নিজের ছাপাখানা থাকায় মুদ্রণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও ব্যাপক আগ্রহ ছিল। পত্রিকার প্রচ্ছদ বা ভেতরে চার রং ব্যবহার করার পাশাপাশি নান্দনিক বাংলা হরফ ব্যবহার করার ইচ্ছাটা তখন প্রবল হয়ে ওঠে।
দুনিয়ায় তত দিনে ফটোটাইপসেটার নামের হরফ প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়েছে। ১৯৮৬ সালের দিকে সেটি বেশ ব্যাপকতা পায়। বাংলা দু-একটি দৈনিক পত্রিকা ফটোটাইপসেটার ব্যবহার করা শুরু করে। আমারও ইচ্ছা জাগে নিজের পত্রিকার জন্য একটি ফটোটাইপসেটার কিনতে পারি কি না। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বিলাত সফর করি। বিলাতের এ এম ভেরিটাইপার নামের একটি টাইপসেটার উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কারখানাতেও যাই। এক সেট ফটোটাইপসেটার কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে জানতে পারি যে সাধারণ পার্সোনাল কম্পিউটার দিয়ে ফটোটাইপসেটারের কাজ করা যায়। টাইপসেটারের শতভাগের একভাগ খরচে এই কাজ করা যায় বলে শেষ মুহূর্তে ভেরিটাইপার না কিনে ঢাকায় ফিরে এসে জানতে পারি যে ঢাকা কুরিয়ার নামক একটি পত্রিকা তত দিনে কম্পিউটার দিয়ে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। কাকরাইলের আসিফ ম্যানসনের বিজনেস অ্যান্ড এডুকেশন সফটওয়্যার লিমিটেড ঢাকা কুরিয়ার প্রকাশে প্রযুক্তি সরবরাহ করায় আমি তাদের কাছে ধরনা দিই। প্রতিষ্ঠানটির কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন হাফিজ ভাই। তিনি আমার সাংবাদিকতা জীবনের সূচনায় অগ্রজ হিসেবে প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
হাফিজ ভাইকে জানালাম যে আমি কম্পিউটারের তৈরি করা অক্ষর দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করতে চাই। হাফিজ ভাই জানান যে রোমান হরফ নিয়ে ঢাকা কুরিয়ার প্রকাশ করা গেলেও বাংলা হরফ দিয়ে কিছু করা যাবে কি না, সেটি তিনি বলতে পারেন না। তিনি আমাকে সৈয়দ মাইনুল হাসান নামের এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মইনুল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হলেও মেকিনটোশ কম্পিউটার চালনায় দক্ষ ছিলেন। তিনিই আমাকে একটি বাংলা ফন্ট দেখালেন, যার নাম বঙ্কিম। তিনিই জানান যে ফন্টটি কলকাতার রাহল কমার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে। ফন্টটি দেখে প্রথম সংকট যেটা পেলাম, সেটা এর কি-বোর্ড। এই কি-বোর্ড আমাদের চেনা নয়। অক্ষরের মান মোটেই ভালো না হলেও আমি কম্পিউটার দিয়েই আমার সদ্য অনুমোদনপ্রাপ্ত আনন্দপত্র প্রকাশের বিষয়ে অনড় ছিলাম।
মাইনুল সাহেবকে আমি বঙ্কিম ফন্টটিকে একটু উন্নত করে সেটি অপটিমা মুনীর কি-বোর্ড অনুসারে সাজিয়ে দিতে অনুরোধ করলাম। অপটিমা মুনীরকে ভিত্তি করে দুই স্তরের কি-বোর্ডকে চার স্তরে রূপান্তরের নকশাটা করেও দিলাম। এর নাম দিলাম জব্বার কি-বোর্ড—আমার বাবার নামে। মাইনুল সাহেব ১৯৮৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি বঙ্কিমের নতুন রূপ আমাকে দেখালেন। তিনি নিজে সার্কিট হাউস রোডে বাংলা কম্পিউটার সার্ভিসেস নামে একটি ডিটিপি (ডেস্কটপ পাবলিশিং) হাউসও স্থাপন করলেন। তিনি ফন্টটির নাম দিলেন মাইনুল লিপি। আমি যাচাই করে দেখলাম যে মুনীর অপটিমা ব্যবহারকারীরা ফন্টটি সহজেই ব্যবহার করতে পারে।
তখন সময় এল নিজের ঘরে কম্পিউটার নেওয়া এবং সেটিকে আমার প্রকাশিতব্য আনন্দপত্র প্রকাশের কাজে লাগানো। ২৮ এপ্রিল ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় মেকিনটোশ কম্পিউটারটি কিনে আমার আরামবাগ অফিসে নিয়ে আসি। প্রুফ দেখার জন্য সঙ্গে কিনি ইমেজরাইটার নামের একটি ডট মেট্রিক্স প্রিন্টার। সেটিরও দাম ছিল ২৮ হাজার টাকা।
এর আগের জীবনে কোনো দিন কম্পিউটারের বোতাম স্পর্শ করিনি। কোনো প্রকৌশলীও আমার কম্পিউটার স্থাপনে আসেননি। মেকিনটোশের বাক্স খুলে তার মধ্যে থাকা ইংরেজি নির্দেশিকা বইটি দেখে সেটি চালু করি। একটি সাড়ে তিন ইঞ্চি ফ্লপি ড্রাইভে অপারেটিং সিস্টেম ও ম্যাকরাইট সফটওয়্যার দিয়ে মাইনুল লিপি ফন্টে বাংলা টাইপ করে সূচনা করি ৩০ বছরের সেই যাত্রাটি, যার জন্য আমি একজন বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে গৌরব বোধ করি। স্মরণ করি হাফিজ ভাই, মাইনুল, খসরু ভাই, পলিন ও আবদুল হকের কথা, যাঁদের জন্য ১৯৮৭ সালের ১৬ মে বাংলা ভাষার প্রথম কম্পিউটারে কম্পোজ করা পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশিত হয়।
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও সভাপতি, বেসিস