কম্পিউটার ভাইরাসের নেপথ্যের কথা

১৯৪৯ সাল—কম্পিউটিংয়ের দুনিয়া এক দশক পার করে তখন সবে দাঁড়াচ্ছে। হাঙ্গেরি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী জনভন নিউম্যান অদ্ভুত এক তত্ত্ব দিলেন। তিনি বললেন, স্বপ্রতিলিপি তৈরি করতে পারে, এমন প্রোগ্রাম লেখা সম্ভব। তাঁর ওই তত্ত্বই পরে কম্পিউটার ভাইরাস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ ধরনের প্রোগ্রামগুলো চালু হতে একটি আশ্রয়দাতা (হোস্ট) প্রয়োজন হয়। এগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়, যাতে আক্রান্ত কম্পিউটারে অননুমোদিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারে।

শুরুতে ভাইরাসের নকশা ও পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে করা হতো। প্রথমবারের মতো পরীক্ষাগারের বাইরের কোনো কম্পিউটারে তৈরি হয় ‘এল্ক ক্লোনার’ নামের একটি ভাইরাস। ১৯৮২ সালে পেনসিলভানিয়ার ১৫ বছর বয়সী স্কুলবালক রিচ স্ক্রেনটা এমন এক প্রোগ্রাম লেখে, যা ফ্লপি ডিস্কের মাধ্যমে অ্যাপল টু কম্পিউটারকে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রতি ৫০ বার পরপর কম্পিউটার রিবুটিংয়ের সময় এই প্রোগ্রামটি একটি ছোট্ট বার্তা দেখাত। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটাই ছিল মজা করার উদ্দেশ্যে, স্ক্রেনটা ও তার বন্ধুদের গণ্ডির বাইরে কেউ জানত না এবং একে ভাইরাস বলা হতো না। ওই সময় ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টি ফ্লপি ডিস্কের ওপর নির্ভর করত বলে তা কখনো নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করেনি। অবশ্য এ নিয়ে মতভেদ আছে।

কেউ কেউ বলেন, ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর কম্পিউটার ‘ভাইরাস’-এর জন্ম হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ফ্রেড কোহেন পেনসিলভানিয়ার লেহিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক এক সেমিনারে প্রথম কম্পিউটার ভাইরাস দেখান। একটি মেইনফ্রেম কম্পিউটারে তিনি তাঁর ছোট্ট সংকেত (কোড) প্রবেশ করিয়ে মাত্র ৫ মিনিটেই গোটা যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। আরও চারটি প্রদর্শনীতে গড়ে মাত্র আধা ঘণ্টা সময়েই এই কোড ব্যবহার করে সব নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে গোটা সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন তিনি। কোহেনের উপদেষ্টা লেন অ্যাডলেম্যান তাঁর এই নিজে থেকেই নিজের অনুলিপি (রেপ্লিকা/কপি) সৃষ্টির প্রোগ্রামটিকে ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করেন এবং একে ‘ভাইরাস’ নামে অভিহিত করেন। সেই থেকে এমন ক্ষতিকর প্রোগ্রামের নাম হয়ে গেল কম্পিউটার ভাইরাস। কিন্তু কারও কারও মতে, এটাই প্রথম ভাইরাস নয়। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন প্রথম ভাইরাসের নাম ‘ক্রিপার’ (১৯৭১)। কেমব্রিজভিত্তিক বিবিএনের কম্পিউটার প্রোগ্রামার রবার্ট (বব) থমাস ছোট একটা প্রোগ্রাম লেখেন, যা নিজে নিজেই অনুলিপি তৈরি করতে পারত। এটা ছিল পরীক্ষামূলক।

এবার জানা যাক, প্রচলিত ভাইরাস, কম্পিউটার ওয়ার্ম, ক্ষতিকর ম্যালওয়ার ও হালের র‍্যানসমওয়্যার সম্পর্কে

ভাইরাস : কম্পিউটার ভাইরাসের এমন নামকরণের কারণ হলো, এই প্রোগ্রামগুলো জীবদেহের ভাইরাসের মতোই আচরণ করে থাকে। জীবদেহের ভাইরাস যেমন কোষের মতো নিজে থেকে নিজের অনুলিপি (রেপ্লিকা) তৈরি করতে পারে না, কম্পিউটার প্রোগ্রামটিও তেমনই, প্রোগ্রামটিতে ক্লিক না করলে চালু হয় না। ভাইরাস যেমন এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়ায়, কম্পিউটার ভাইরাসও তেমনই এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ছড়ায়। দুটিই ক্ষতিকর ও আকারে ছোট। ১৯৯৯ সালে ই–মেইলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মেলিসা নামের একটি ভাইরাস। মেলিসা নামের আবেদনময়ী এক নৃত্যশিল্পীর নামে ভাইরাসটির নামকরণ করেন এর নকশাবিদ ডেভিড এল স্মিথ। ভাইরাসটি ঠিকমতো চালু হতে একটি আশ্রয়দাতার দরকার হতো। ই–মেইলে একটি ওয়ার্ডডকুমেন্ট আশ্রয় করে ভাইরাসটি ছড়ায়। যখন এতে ক্লিক করা হতো ভাইরাসটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিলিপি তৈরি করে ই–মেইলের অ্যাড্রেসবুকে থাকা আরও ৫০ জনকে পাঠিয়ে দিত।

কম্পিউটার ভাইরাস
কম্পিউটার ভাইরাস

ওয়ার্ম : ভাইরাসের যেমন আশ্রয়দাতার দরকার হয়, ওয়ার্মের হয় না। এটি এমন অ্যাপ্লিকেশন, যা নিজেই প্রতিলিপি তৈরি করে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়। ২০০০ সালের মে মাসে লাভ বাগ, লাভ লেটার বা আইলাভইউ নামের একটি ওয়ার্ম ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে ফিলিপাইনে কিছু কম্পিউটারে আক্রমণের পর ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়ায় এটি। এটি লাভ লেটার, ভিবিএস বা লাভ বাগ ওয়ার্ম নামেও পরিচিত। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশ্বব্যাপী কয়েক লাখ উইন্ডোজ কম্পিউটারে ছড়িয়ে পরেছিল এটি। ফিলিপাইনের এক কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ের শিক্ষার্থীর বানানো এ ভাইরাসটি একটি অ্যাটাচমেন্টসহ ই–মেইলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ত। ফাইল ওভার রাইটিং করে এর কপি কম্পিউটারের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখত। কম্পিউটারে সংরক্ষিত ই–মেইল ঠিকানাগুলোতে স্বয়ংক্রিয় মেইল পাঠাত পারত।

ম্যালওয়্যার: কম্পিউটারকে আক্রমণ করে এমন ক্ষতিকর সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামের সাধারণ নাম ম্যালওয়্যার। এর মধ্যে ভাইরাস, ওয়ার্ম, ট্রোজান হর্স, স্পাইওয়্যার প্রভৃতি রয়েছে। এর মধ্যে ট্রোজান হর্স হলো ছদ্মবেশী ম্যালওয়্যার বা প্রোগ্রাম, যা কম্পিউটার হ্যাক করতে ব্যবহার করা হয়। ট্রোজান হর্স বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে। যেমন-২০০৭ সালে স্টর্ম ওয়ার্ম নামের একটি ট্রোজান হর্স ছড়িয়ে পড়ে। এটি ই–মেইলে একটি বিশেষ বার্তা আকারে ছড়ায়। এটি খবরের আড়ালে লুকানো ছিল ওই ম্যালওয়্যারটি। যখন ওই ম্যালওয়্যারটি খোলা হতো, এটি কম্পিউটারে ইনস্টল হয়ে হ্যাকারদের জন্য আড়ালে একটি জায়গা করে দিত। এতে কম্পিউটার রোবটের মতো অন্যদের স্প্যামিং করত। ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে ব্যক্তিগত তথ্য চুরির পাশাপাশি ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

র‍্যানসমওয়্যার : র‍্যানসমওয়্যার একধরনের ম্যালওয়্যার, যা সাইবার চাঁদাবাজিতে ব্যবহৃত হয়। এ ট্রোজানটি একটি র‍্যানসমওয়্যার ইনস্টল করে কম্পিউটারের তথ্য আটকে ফেলে। এতে কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটি বার্তা আসে, যাতে তথ্য ব্যবহার করতে অর্থ দাবি করা হয়। অনেক সময় ডিজিটাল কারেন্সি হিসেবে বিটকয়েন চাওয়া হয়। গত মাসে বিশ্বজুড়ে ১৫০টি দেশের দুই লাখের বেশি কম্পিউটারে আঘাত হানে ‘ওয়ানাক্রাই’ নামের একটি র‍্যানসমওয়্যার। বিশ্বব্যাপী এই হামলায় হ্যাকাররা কম্পিউটার থেকে ফাইল নিয়ে নেয় এবং সেগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য ২৮টি ভাষা ব্যবহার করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়।

তথ্যসূত্র : টেলিগ্রাফ, গ্যাজেটস নাউ।