ডিজিটাল বিপ্লবের যুগেও মানুষ থাকুক এগিয়ে

এক ভদ্রলোক ফোনে পিৎজার অর্ডার দিতে গিয়ে জানলেন, তিনি কথা বলছেন যান্ত্রিক এজেন্টের সঙ্গে। বিস্মিত হয়ে দেখলেন কথার সূত্র ধরে ওই এজেন্ট তাঁর খাবারের পছন্দ-অপছন্দ, স্বাস্থের অবস্থা, অর্থকড়ির হিসাব, আয়কর, চলাফেরা সম্পর্কে জানে। এই যান্ত্রিক প্রতিনিধির ভিত্তি হলো বট ফ্রেমওয়ার্ক প্রযুক্তি, যাতে মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে গ্রাহকের বিভিন্ন সূত্রের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো মনে হলেও, এই ধরনের যান্ত্রিক এজেন্টের ব্যবহার কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপক হারে দেখা যাবে।

গত শতাব্দীর প্রথম দিকে আবিষ্কৃত হয়েছিল বিদ্যুৎ—যা শিল্প, কারখানা, গাড়ি, যোগাযোগব্যবস্থা এবং পরবর্তী সময়ে কম্পিউটার উদ্ভাবনে সহায়ক ছিল। এখন আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। মুঠোফোনে সুপার কম্পিউটারের মতো ক্ষমতা, কৃত্রিম-বৃদ্ধিমত্তার রোবট, স্বচালিত আর উড়ন্ত গাড়ি, নবায়নযোগ্য শক্তি কিংবা মানুষের চেহারা স্ক্যান করে মনোভাব জানা—এ রকম আরও সব প্রযুক্তি দেখা যাচ্ছে, যেগুলো আগের উদ্ভাবনগুলো থেকে আলাদা।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বস্তু, যন্ত্র ও মানুষের মধ্যে নানামুখী প্রযুক্তির একক ও আন্তযোগাযোগ ঘটিয়ে আমাদের জগতে আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে নিয়ম-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি ও শিল্পে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো গাড়ির মালিকানা ছাড়াই বিশ্বের বড় পরিবহনসেবা কোম্পানি উবার কিংবা নিজেদের কোনো হোটেল-রিসোর্ট না থাকার পরেও বিশ্বের বড় আবাসিক হোটেল সেবা এয়ার বিএনবির কথা।

প্রশ্ন হলো, সব প্রযুক্তি কি আমাদের জন্য উপকারী, গ্রহণযোগ্য! বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন একজন ফরাসি প্রযুক্তিবিদ ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) কথা বলতে গিয়ে জোর দিয়েছেন মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের দিকে। কিন্তু উন্নত জীবনের মানদণ্ডের কোনো সঠিক ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা কী আছে!

আইওটির কথাই বলি—আপনার ঘরে যে বিদ্যুৎতের মিটার আছে, তা সংযুক্ত হবে আপনার ঘরের ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, এসি এবং অন্যান্য সেন্সরযুক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক পণ্যের সঙ্গে। এতে আপনার বিদ্যুৎ ব্যবহারের সঠিক পরিমাণ মাপা যাবে, অপচয় কমবে, সাশ্রয় হবে এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে আপনি ঘরের বাইরে থেকেও যন্ত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কিন্তু অসুবিধার দিক হচ্ছে ঘরের গোপনীয়তা ব্যাহত হবে, প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়বে ও কারিগরেরা কাজ হারাবেন।

একটি বুদ্ধিমান নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় আপনার তথ্যগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকবে। এভাবে সবকিছু সবার কাছে খোলা বইয়ের মতো সহজে চলে গেলে, আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে কী থাকে, আপনি কি স্বস্তিবোধ করবেন! সে জন্যই প্রশ্ন উঠেছে, প্রযুক্তি আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে! এসব ভাবনা থেকে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি চলে আসে। আজকাল স্মার্টফোনে বেশির ভাগ অ্যাপ্লিকেশন নামানোর আগে, আপনাকে সম্মত করিয়ে নেয় যে তারা আপনার মোবাইলে বা ল্যাপটপে রাখা ছবি, ভিডিও, কন্টাক্ট লিস্ট, আপনার ঠিকানা বা অবস্থান প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। আবার কোনো একটি সাইটে নিবন্ধন করতে গেলেই তারা আপনার ফেসবুক, গুগল বা টুইটার অ্যাকাউন্টের ই-মেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে আপনাকে সাইনআপ করতে বলবে। এভাবে তারা নির্বিঘ্নে আপনার ফেসবুক বা টুইটারে রাখা সব তথ্য জানার, দেখার, সংগ্রহ করার সুযোগ পেয়ে গেল। যেগুলোর সঙ্গে সাইটটি ব্যবহারের আপাত কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, ভিডিও, বন্ধুদের তালিকা, আপনার পোস্টের তথ্য কোন ওয়েবসাইট কোথায়, কীভাবে ব্যবহার করছে। আপনার তথ্য যেকোনো অপরাধী দলের কাছে যাচ্ছে না, ফেসবুকের পোস্টের ধরন দেখে, আপনার আর্থিক অবস্থা জেনে ফোনে চাঁদা চাওয়া কিংবা অপহরণের মতো ঘটনা ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে হ্যাকারদের কম্পিউটার প্রবেশ করে ফাইল হ্যাক করা এবং ফাইল ফেরত দেওয়ার শর্ত হিসেবে মালিকদের কাছে টাকা চাওয়ার ঘটনা সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি আরও প্রকট করে তুলেছে। কিছুদিন আগে পৃথিবীজুড়ে র‍্যানসমওয়্যার আক্রমণের ঘটনা নিশ্চয়ই মনে আছে।

ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, মেসেঞ্জার বা অ্যাপস ব্যবহার করে এত নিরাপত্তা সমস্যা আসছে, তাহলে ভেবে দেখুন স্মার্টযন্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবট, ড্রোন, আইওটি এসব আরও কত রকম নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি করবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এভাবেই প্রযুক্তিগত সিস্টেম, রোবট আর যন্ত্রগুলো আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের সমকক্ষÿহয়ে উঠবে, আমাদের শাসন করবে। তবে জার্মানির প্রযুক্তি ভবিষ্যৎ-বক্তা জার্ড লিওনার্ড এই আশঙ্কা করছেন না। তিনি বরং মানুষকে নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাঁর মতে, আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় হলো মানুষ যেন যন্ত্রের মতো না হয়ে ওঠে! আপনার চারপাশের যন্ত্রগুলো যখন আপনার কাজ করে দেবে, আপনাকে কিছু খুঁজে দেখতে হবে না, মনে রাখতে হবে না, ভাবতে হবে না, আর এসবই আপনার মস্তিষ্ককে করে তুলবে অকার্যকর। জার্ড লিওনার্ডের কথায়—প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করুন, কিন্তু নিজে এর অংশ হয়ে যাবেন না।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী