প্রযুক্তি কি আসক্তি?

স্মার্টফোন আমাদের বারবার তাগাদা দেয় ওটা খুলে দেখার। ছবি: রয়টার্স
স্মার্টফোন আমাদের বারবার তাগাদা দেয় ওটা খুলে দেখার। ছবি: রয়টার্স

ছেলে অম্লানের (আসল নাম নয়) সঙ্গে কথা বলছিলেন জহির সাহেব (আসল নাম নয়)। লক্ষ করলেন, ছেলে হুঁ-হাঁ করে কথার জবাব দিচ্ছে আর একটু পর পর তার স্মার্টফোনের স্ক্রিন সোয়াইপ করছে। বিরক্ত হলেন জহির সাহেব, কিন্তু জানেন, শুধু অম্লান কেন, আস্ত প্রজন্মটাই একরকম এমন।

আসলেই তা-ই। এমন দৃশ্য আপনি হরহামেশা দেখবেন। রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, মুভি থিয়েটারে। এমনকি অফিসেও। এগুলো এখন অনেকটাই গা সয়ে গেছে মানুষের। ক্ষেত্রবিশেষে কাজের গতি বাড়ছে, অফিসের জরুরি মেইলের জবাব দেওয়া যাচ্ছে দ্রুত।

বন্ধুর বিয়ে কিংবা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন কীর্তি নজর এড়াচ্ছে না কারও। অন্তত প্রযুক্তির দোকানদার এ কথা বলেই আমাদের সবার পকেটে এনে দিয়েছে স্মার্টফোন, উসাইন বোল্ট-গতির ইন্টারনেট।

স্মার্টফোনের ব্যাপারটা অনেকটা ফ্রিজের মতো, বারবার খুলে দেখা নতুন কিছু আছে কি না। ব্যতিক্রম এখানে, স্মার্টফোন আমাদের বারবার তাগাদা দেয় ওটা খুলে দেখার। এখানে ছোট একটা রিংটোন, ওখানে একটু খানি ভাইব্রেশন। আমাদের মাথায় কাজ শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। হয়তো জরুরি কাজের ই-মেইল, কিংবা জিগরি দোস্তের ফিচেল রসিকতা। প্রতিটি কাজের শেষেই একটা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। বসের প্রশংসা, কিংবা ইয়ার দোস্তের দম ফাটানো হাসির গল্পটা শুনতে পারা।

এদিকে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) ভিডিও গেম আসক্তিকে গেমিং ডিসঅর্ডার আখ্যা দিচ্ছে। অর্থাৎ গেম খেলা বন্ধ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আপনি বা আমি অসুস্থ। ডিজিটাল যুগে ডব্লিউএইচও এবার ডিজিটাল ‘ওয়েল বিয়িং’-এর দিকে নজর দিচ্ছে। এখন শুধু হেরোইন বা কোকেন নয়, মানুষ আসক্ত হতে পারে ডিজিটাল প্রযুক্তিতেও।

প্রথমে আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রযুক্তি সেবাগুলো স্রেফ সেবা নয়; প্রতিটা সফটওয়্যার বা সেবা একেকটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি হয়ে বসেছে। আধুনিক যুগের কোটিপতিরা হেনরি ফোর্ড, আলভা এডিসন বা এনজো ফেরারির মতো যন্ত্রদানো তৈরি করে পয়সাকড়ি বানাননি। এখনকার কোটিপতি ক্লাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখচোরা, ময়লা জিনস পরা প্রোগ্রামারদের দখলে।

এই সফটওয়্যারের ডিজাইন এমনই, বারবার ঘুরে আসতে মন চাইবে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, অনলাইন শপিং, গেমিং জানে কীভাবে ভোক্তাকে হাজারবার ফিরিয়ে আনতে হয়। আপনার একটা ছবি, মনের কথা অনলাইনে অল্প সময়ই থাকবে। তাই একে করতে হবে আকর্ষণীয়, করতে হবে চিত্তাকর্ষক। যত বেশি লাইক পড়বে, কমেন্ট আসবে, অনলাইনে আমার পায়ের চিহ্ন থেকে যাবে তত বেশি।

আরও আছে দলে থাকার প্রবণতা; একটি আর্টিকেল রিটুইট পেয়েছে ২০ হাজার। মানে জম্পেশ, আমাকেও করতে হবে শেয়ার। পিছিয়ে পড়লে চলবে না, বোল্ট-গতির ইন্টারনেটের সঙ্গে ছুটতেই হবে। আছে সবার সঙ্গে থাকার অনুভূতি। বিবর্তনের ধারাতেই মানুষের আছে সবার সঙ্গে মিলিয়ে চলার প্রবৃত্তি, সেটাকেই কাজে লাগিয়ে প্রচুর বাণিজ্য করে নিচ্ছে প্রযুক্তিবেনিয়া। তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমাদের অধুনা ডিজিটাল আসক্তি।

সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট আমাদের দিচ্ছে ইনফোটেইনমেন্ট। ওতে আছে এমন কিছু, আমরা নতুন কিছু জানতেও পারছি, আবার স্কুলঘরের ক্লাসের মতো বিরক্তির উদ্রেকও হচ্ছে না। মানুষের আজন্মলালিত কৌতূহল আর আনন্দের আকাঙ্ক্ষা, দুটোকেই একসঙ্গে নাড়া দিচ্ছে এই ডিজিটাল জগৎ। এখানে যেন হারানোর কিছু নেই।

তবে এটা মানুষের জন্য একেবারেই অভূতপূর্ব, ব্যাপারটা সে রকম না। সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের মিথস্ক্রিয়ার গতি বাড়িয়েছে বহু গুণ। সঙ্গে ঘরে শুয়ে-বসেই করা যাচ্ছে বিশাল আলোচনা, নিছক আড্ডা কিংবা জরুরি কাজ। শুরুতে কাজের মনে হলেও প্রতিবার প্রযুক্তি জগতের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে আমাদের মগজে ক্ষরণ হচ্ছে ডোপামিন।

রুশ সাইকোলজিস্ট আইভান পাভলোভিচের একটা পরীক্ষা ছিল। তাঁর কুকুরকে প্রতিদিনের খাবার দেওয়ার আগে একবার করে ঘণ্টা বাজাতেন পাভলোভিচ। কিছুদিন পর দেখা গেল, ঘণ্টা বাজলেই কুকুর খাবার জন্য তৈরি, মুখ থেকে লালা ঝরছে, খাবারের জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়েছে পাভলোভিচের কুকুর।

আমরাও এখন নোটিফিকেশনের শব্দে পাভলোভিচের কুকুরের মতোই ডোপামিনের খোঁজে ফোনের স্ক্রিনে হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দিলে লোকের মধ্যে মাদকাসক্তদের মতোই আচরণ দেখা যায়। মেজাজ খিঁচড়ে যাওয়া, স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারলে ভালো মেজাজ ফিরে পাওয়া। সবই একজন হেরোইন আসক্তের চেহারা মনে করিয়ে দেয়।

রাস্তা পার হওয়ার সময় ফোনে মুখ গুঁজে থাকা, বিপজ্জনক জায়গায় নিজস্বী তোলার হিড়িক কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় যেতে না পারার আক্ষেপ, কিছুতে যোগ দিতে না পারার বিলাপ এসবই এখন প্রতিদিনের দৃশ্য। পাভলোভিচের কুকুরের মতো ছুটছি সবাই।

তবে ঘটনাটা এমন নাও হতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তি আরক, হেরোইন, কোকেন বা অন্যান্য মাদকের মতো বল্গাহীন ঘোড়া নয়। এই প্রযুক্তির বিষয়ে আমরা চাইলেই জেনে-বুঝে সমঝে চলতে পারি। সফটওয়্যার-বেনিয়াদের আনতে পারি নজরদারিতে, আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তিকে করতে পারি আরও বেশি মানবিক, মানব-উপযোগী। তাতে হয়তো বাজারে কিছু ভাটা পড়বে, তবে প্রশ্নের জবাব আমাদের আগে জানতে হবে, বাজারের জন্য মানুষ, নাকি মানুষের জন্য বাজার।