নেটফ্লিক্স: বিগ ডেটা ও থিক ডেটার যুগলবন্দী

বাজারি আলাপেই শুরু করা যাক। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সবই যখন খোলা বাজারে বিকোচ্ছে, দোকানের গুণ না গেয়ে কোনো কথাই আসলে শুরু করা যায় না। এই বাজারে সংখ্যার বড়ই কদর। সংখ্যার বিচার আসলে সহজ; ১০০ টাকার পণ্য আর হাজার দশেকের মধ্যে ভেদবিভাজন সহজেই করে ফেলা যায়। দিনের শেষে ব্যবসাদারের সহজ লাভ-ক্ষতির হিসাবের কদরই বেশি।

তবে কি না সংখ্যাতত্ত্বের কচকচিতে ছোট একটা ঘাপলা আছে। শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর পারমুটেশন আর কম্বিনেশনের ধন্দ লাগা গ্ল্যামারে সে খটকা আমাদের চোখে পড়ে না। আপনার আমার চোখে না পড়লেও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী নীহারিকার মনে এই খটকা বহুদিন ধরেই কড়া নাড়ছে।

পরীক্ষায় ১০০ পেলে রোল নম্বর কেন এক হয়? ১০০ যদি বেশি হয়, সেটা সব সময়ই বেশি হওয়ার কথা। রোল নম্বরের ক্ষেত্রে ১০০ আবার মন্দ কেন হবে? প্রশ্নটা শুনে পাকামি মনে হলেও সেটা আমাদের ভাবায়। শুধু প্রেক্ষাপটের বদলে দেখুন কেমন পালটে গেল ১০০-এর মূল্য।

অ্যাডাম স্মিথ যতই বলুন মানুষ অর্থলিপ্সু, কথাটা পুরোটা ঠিক না। মানুষের কাজে-কর্মে অন্যান্য মূল্যবোধ জড়িয়ে থাকে। ধরুন ঈদের কেনাকাটা, সবাই জানি ঈদের আগে আগে বিপণিবিতানে পণ্যের দাম চড়বে। আমরা সেটা নিয়ে গজগজও করব। তবে উপোস থেকে, বাজার হাঁকিয়ে একগাদা জিনিসপত্র কিনে সুপার মার্কেটের কোনো এক দোকানে তিন-চার গুণ বেশি দাম দিয়ে ইফতারি না করলে সেবারের ঈদ আমাদের মাটিই যায়।

তাই সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্যের বিচারে যতই মাতামাতি করি না কেন, দিনের শেষে শীতল ক্রূর সংখ্যার বিচারে আমাদের জীবন চলে না। চলে এই সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে। ভেবে দেখুন, একসময় স্মার্টফোন ছিল ‘বেয়াদব ছেলেপেলের জিনিস’। অন্তত আমাদের বাপ-মা তা-ই বলেছিলেন। আমরাও সেটা মেনে নিয়েছিলাম। যদিও স্মার্টফোনের ইউজার ম্যানুয়ালে কোথাও লেখা নেই ধনীর দুলালই ওটা ব্যবহার করবে, নিজেরাই তৈরি করেছিলাম সেই উটকো নতুন মূল্যবোধ।

এমনটা ঘটেছিল নকিয়ার সঙ্গেও। ২০০৯ সালে ত্রিশিয়া ওয়াং কাজ করছিলেন নকিয়ার হয়ে। গবেষণা করছিলেন কীভাবে আরও জনবান্ধব বিপণন মডেল তৈরি করা যায়। বহুদিন কাজ করেছেন চীনের মানুষের মাঝে। কখনো দিন-রাত কাটিয়েছেন প্রবাসী কর্মীদের আড্ডায়, কখনো-বা রাস্তায় বিক্রি করেছেন খাবার।

এথনোগ্রাফারদের কাজের ধরনটাই ওই রকম। সেই কাজে মন দিয়ে নতুন দিশা পেয়েছিলেন ত্রিশিয়া। দেখলেন, চীনা জনগণ স্মার্টফোন কিনতে প্রস্তুত। কম দামে ফিচার ফোন কেনার থেকে কিছু বেশি দিয়ে স্মার্টফোনে নিজের পকেট ভারী করতে সবাই চাইছে। তবে তার জন্য নতুন ধরনের স্মার্টফোন দরকার। আকাশচুম্বী দামও না, সাধ ও সাধ্যের অপূর্ব যুগলবন্দী।

রাজি হয়নি নকিয়া। তাদের তথ্যজ্ঞানীর দল ত্রিশিয়া ওয়াংয়ের পর্যবেক্ষণ মানতে নারাজ। তাদের হাতে আছে লাখ লাখ ভোক্তার ব্যাংকের হিসাব, খরচের খাতা, ইন্টারনেট সার্ফিংয়ের তথ্য, আরও কত-কী। ওয়াংয়ের হাতে ১০০ ভোক্তার তথ্য। সেটা ঠিক তথ্যও বলা চলে না; কেমন যেন জীবনের গল্প। কেউ দুপুরের খাবার খেতে খেতে একটু ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে আড্ডা জমাতে ভালোবাসে, কেউবা রাতের খাবারের পর নিজের পকেটে থাকা ফোনে দেখে নিতে চান সে রাতের খেলার খবর। এসব তথ্যকে ঠিক ছকে ফেলা যায় না, মাপতে বসলে তো আরও বেশি জিলাপির প্যাঁচ হয়ে যায়।

নকিয়া ত্রিশিয়া ওয়াংয়ের প্রস্তাব করা বিপণন মডেল নিয়ে কাজ করেনি। তাদের হাজার হাজার টেরাবাইটের ডেটার সামনে এথনোগ্রাফারের ১০০ জীবনের গল্প কপালের শিকে ছেঁড়েনি। নকিয়া তার ব্যবসা করার পদ্ধতি বদলায়নি।

এরপর কী হয়েছে, সেটা আর বলে দিতে হবে না। নকিয়ার একসময়ের ফোনজগতের মুঘল সালতানাত, তাসের ঘরের মতো উড়ে যায়। ব্যবসায় যেনতেন ক্ষতি না, একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় নকিয়া। কান্নাভেজা কণ্ঠে কর্মীদের বিদায় জানান সিইও। নকিয়াকে কিনে নেয় মাইক্রোসফট, ২০১৩ সালে।

গন্ডগোলটা আসলে ‘বিগ ডেটা’ আর ‘থিক ডেটা’র মাঝে। বিগ ডেটা এখনকার কোম্পানিগুলোর কাছে স্বপ্নে পাওয়া সর্বরোগের মহৌষধ। প্রচুর গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করে দেওয়া যায় বিগ ডেটায়। কতবার এক রেস্টুরেন্টে গেছে ভোক্তা, কী ফরমাশ করেছেন, কী খেয়েছেন, কতবার খেয়েছেন—এ রকম হাজার হাজার তথ্য থেকে ধীরে ধীরে একটা প্যাটার্ন বের হয়, তৈরি হয় অ্যালগরিদম। সেই অ্যালগরিদমের কারিকুরিতে ভোক্তার প্রোফাইল পরিষ্কার। গ্রাহক আর ভোক্তা যে লেন্সেই পৃথিবীকে দেখতে চান, ঠিক সেটাই দেখাতে পারবে বড় ব্যবসাদারেরা।

ইন্টারনেটের শুরুর দিকে ঘটনাটা এ রকম ছিল না অবশ্য। তখন কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। ইন্টারনেট ব্যবহারকে নিজের অলস দুপুরের কফি খাওয়ার বাগানবাড়ি বানানোর তাড়না ছিল না কারওরই। তাই মাঝেমধ্যে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তিও হজম করতে হয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রকে টিকতে হলে যেটা খুবই জরুরি।

অধুনা চৌকস মুঠোফোনের দৌরাত্ম্যে, ইন্টারনেট ফরাসি আঁতেলদের আড্ডার কাফের ভোল পালটে এখন ব্যক্তির বাগানবাড়ি। এখানে তিনি আসেন কফি খেয়ে একলা আয়েশ করতে, কখনো-বা মেক্সিকানদের গালি দিতে, কিংবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নকে চাঙা করতে। এখানে বিরুদ্ধ মতের সুযোগ নেই। স্রেফ নিজ পছন্দের লাল-গোলাপি ফ্রেমে দেখা দুনিয়া।

সেই সুযোগই নিতে চেয়েছিল আমাজন, গুগল কিংবা ফেসবুক। সেটাকে একেবারে সরাসরি পণ্য বানিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তথ্য জোগাড় করে একেবারে গণতন্ত্রের মেঠোবুলির সিংহাসন অর্জন। রাশান অলিগার্কের পকেট থেকে কিছু টাকা নিয়ে, আধুনিক দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অহংকার গণতন্ত্র বিকিনি পরে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নিজেকে বেচতে নেমেছে।

আশার কথা, এই বাণিজ্য ধোপে টেকেনি; মার্ক জাকারবার্গকে চাইতে হয়েছে ক্ষমা। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ব্যবসার সলিলসমাধিতে দুফোঁটা চোখের জল ফেলারও কেউ নেই। মাঝে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে নেটফ্লিক্স। নকিয়ার মতো ভুল করেনি ওরা, এথনোগ্রাফারের কথা শুনেছে। সংখ্যার ভূতের একটু সদ্‌গতি করে, বিগ ডেটা আর থিক ডেটার জুটি বেঁধে করছে ব্যবসা। যখন নারকোসের লাইভ স্ট্রিমিং হয়, পৃথিবীর অনেক দেশে অত জনসংখ্যাও নেই, যতজন পাবলো এস্কোবার আর কালি কার্তেলের অন্ধকার জগৎ দেখতে নেটফ্লিক্সে বুঁদ হন।