এক সফটওয়্যারে রোগীর সব তথ্য

সফটওয়্যারে ব্যবহারকারীদের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে । ছবি: সংগৃহীত
সফটওয়্যারে ব্যবহারকারীদের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে । ছবি: সংগৃহীত

আমাদের গ্রাম। নাম শুনলেই নিজের গ্রামের ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রত্যেকের জন্য তার গ্রাম ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। আজ বলব অন্য রকম একটি আমাদের গ্রামের গল্প। এই ‘আমাদের গ্রাম’ উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। অনেক বিষয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। আমাদের গ্রাম স্তন ক্যানসার নির্ণয় ও পরামর্শের জন্য তৈরি করেছে একটি সফটওয়্যার। যে সফটওয়্যারের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ থাকবে রোগীর সব তথ্য। এই সফটওয়্যার তৈরির মূল কাজটি করেছেন বাংলাদেশি প্রোগ্রামাররা।

তথ্যভান্ডার
আমাদের গ্রামের ক্যানসার চিকিৎসা পরামর্শ কেন্দ্র এই সফটওয়্যার ব্যবহার করছে ২০১০ সাল থেকে। যেখানে চলতি বছরের ১৮ জুন পর্যন্ত স্তন ক্যানসার নির্ণয় ও পরামর্শ সেবা নিতে আসা ১৬ হাজার ৯৭৪ জন নারীর সব তথ্য একটি সফটওয়্যারে সংরক্ষিত রয়েছে। সব তথ্যের বেলাতেই নিশ্চিত করা হয়েছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার (প্রাইভেসি) বিষয়টি।

ক্লিকেই সেবা
এক ক্লিকেই রোগীদের সব তথ্য পাওয়া যাবে এ সফটওয়্যারটি থেকে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা ও ঝনঝনিয়া গ্রামে এই প্রকল্পের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে খুলনা শহর পর্যন্ত। খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গায় রয়েছে একটি বিশেষায়িত কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে স্তন ক্যানসার নিরীক্ষা এবং পরে ধাপে ধাপে চিকিৎসা পরিচালিত হয় খুলনা মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সহযোগিতায়। প্রকল্পের রয়েছে নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি স্তন ক্যানসার চিকিৎসা গাইডলাইন যা তাদের ওয়েবসাইটে সবার জন্যই উন্মুক্ত। এই গাইডলাইন প্রণেতা দলের দলনেতা ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি ক্যানসার চিকিৎসক ও গবেষক প্রয়াত ডা. এ বি এম ফজলুল করিম।

সফটওয়্যারের চারটি ধাপ
এই সফটওয়্যার কাজ করে ধাপে ধাপে। একজন রোগীর জন্য মোট ৪টি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। চারটি ধাপেই রোগীর সব তথ্য সফটওয়্যারে লিখে রাখা হয়।

প্রথম ধাপ: প্রকল্পের কর্মী নওরীন সেতু এই সফটওয়্যারের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন। রোগীর প্রথম ধাপের নিবন্ধন তথ্য যুক্ত করে, তিনি রোগীর একটি অ্যাকাউন্ট আইডি তৈরি করেন এবং রোগীকে বুঝিয়ে দেন। নওরীন বলেন, ‘আমার কাছে বোঝাটা ছিল জরুরি, তাই আমি পারছি। এখন তো মনে হয় এটা খুব সহজ কাজ। প্রথম ধাপে প্রাথমিক তথ্য যেমন নাম, ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর ও পারিবারিক বিবরণ সফটওয়্যারে লিপিবদ্ধ করা হয়। অনুমতি নিয়ে ছবিও তোলা হয়।’

দ্বিতীয় ধাপ: সেতুর সুপারভাইজার চামেলী আক্তার। নার্সিং ডিপ্লোমাসম্পন্ন চামেলী আক্তার যুক্ত আছেন প্রকল্পের শুরু থেকেই। রোগীর স্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যক্তিগত তথ্য তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি জানান, এ সফটওয়্যার খুবই আধুনিক ও রোগীবান্ধব। চামেলী আক্তার বলেন, ‘আমাদের সব কেন্দ্র সার্বক্ষণিক ইন্টারনেটেযুক্ত। এই মুহূর্তে রামপালে যদি কোনো রোগী যুক্ত হন তবে সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবখানে তা দেখতে পাই। প্রয়োজন হলে বা পরামর্শ লাগলে আমরা এই সফটওয়্যারের নির্দিষ্ট স্থানে তা উল্লেখ করে দেই। এরপর বিদেশি ডাক্তার যাঁরা যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় থাকেন, তাঁরাও সম্পুর্ণ বিনা মূল্যে মতামত এই সফটওয়্যারের নির্ধারিত স্থানে লিখে দেন বা ই-মেইলে পরামর্শ দেন। কোন রোগীর প্রয়োজনে আমরা ভিডিও কনফারেন্সও করি ও সফটওয়্যারে সব আলোচনা লিখে রাখি।’

তৃতীয় ধাপ: প্রকল্পের তৃতীয় ধাপ ডা. তিমা বিনতে আজাদের তত্ত্বাবধায়নে হয়ে থাকে। সেবা নিতে আসা নারীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ, আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার ফলাফল, উল্লেখ করেন। গাইডলাইনের কোন নিয়মে তিনি ব্যবস্থাপত্র বা পরামর্শ দিচ্ছেন তা সফটওয়্যারে লিপিবদ্ধ করেন তিনি। কোনো রিপোর্ট থাকলে তার ফলাফলও এতে যুক্ত হয়।

চতুর্থ ধাপ: চতুর্থ বা শেষ ধাপে রোগীর সব বিবরণ দেখে ব্যবস্থাপত্রের একটি কপি প্রিন্ট করে প্রয়োজনীয় উপদেশ, পরামর্শ, করণীয় সম্পর্কে রোগী এবং তার আত্মীয়-পরিজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। চামেলী আক্তার জানান, এ চার ধাপ সম্পন্ন করতে সফটওয়্যারে মোট সময় লাগে গড়ে ৩০-৪০ মিনিট।

সফটওয়্যারের মূল পাতা
সফটওয়্যারের মূল পাতা


সফটওয়্যার তৈরির কথা
কেমন করে তৈরি হলো এই সফটওয়্যার? জানালেন প্রকল্পের পরিচালক রেজা সেলিম। তিনি বললেন, ‘২০১০ সালে আমরা যখন এই সেবা চালু করি তখন থেকেই চিন্তা ছিল রোগীর স্বাস্থ্য তথ্য ইলেক্ট্রনিক উপায়ে সংরক্ষণ না করলে, পরে ফলোআপ হবে কেমন করে? তা ছাড়া সব তথ্য না থাকলে এই সেবার মান বজায় রাখা যাবে না। আমাদের সঙ্গে তখন কয়েকজন বিশ্বপরিচিত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ জড়িত ছিলেন যাঁরা এখনো আমাদের পরামর্শ দেন, তাঁরাও বিস্মিত হয়েছিলেন যে আমাদের দেশে স্বাস্থ্য তথ্য রেকর্ড হয় না। কেমন করে এই তথ্যভান্ডার সফটওয়্যার তৈরি করা যায় আজ থেকে ১০ বছর আগে তা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।’

তরুণদের হাত ধরে
এ সফটওয়্যার তৈরি করেছে বাংলাদেশের একদল মেধাবী তরুণ। রেজা সেলিম বলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের পরামর্শে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) একটা দল এ সফটওয়্যার তৈরি করে দেয়। জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী, ফেরদৌস আহমেদ এবং আরও কজন মিলে দাঁড় করান সফটওয়্যারটি। মাত্র আট মাসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার এই সফটওয়্যার তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নিরীক্ষণ করে ২০১১ সালের মে মাসে জেনেভায় তাদের বার্ষিক সম্মেলনে একে ‘ইন্টার-অপারেবল’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। রেজা সেলিম জানান, সফটওয়্যারটি অনলাইনভিত্তিক ও সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটা রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্লাউড সার্ভারে। যা প্রতি সপ্তাহে নিজে থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাকআপ রেখে দেয়।