ইনটেলের ৫০

১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর ইনটেলের কার্যালয়ে গর্ডন মুর (বাঁয়ে) ও রবার্ট নয়েচ। ইনটেল
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর ইনটেলের কার্যালয়ে গর্ডন মুর (বাঁয়ে) ও রবার্ট নয়েচ। ইনটেল

অর্ধশতক আগে যাত্রা শুরু করে ইনটেল। উদ্দেশ্য ছিল উন্নত ভবিষ্যৎ তৈরি। আর সেই থেকেই নতুন নতুন ভাবনা আর সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে উদ্ভাবন করে চলেছে মাইক্রোপ্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৬৮ সালের ১৮ জুলাই রবার্ট নয়েচ ও গর্ডন মুর ইনটেল প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ এই সময়ে সহপ্রতিষ্ঠাতা নয়েচের একটি চ্যালেঞ্জ তাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে, ‘ইতিহাসের পিছুটান এবং সীমাবদ্ধতা থেকে এগিয়ে যাও এবং নতুন কিছু সৃষ্টি করো।’

নয়েচ ও মুর দুজনই ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নয়েচের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছিল তাতে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন। একদিন মুরের কাছে এসে নয়েচ বলেন যে তিনি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন এবং মুর সত্যি সত্যিই নতুন কিছু করতে আগ্রহী কি না। তাঁরা দুজন একসঙ্গে চাকরি ছেড়ে দিয়ে যে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন, সেটিই আজকের ইনটেল।

ইনটেলের নাম

নয়েচ ও মুরের প্রতিষ্ঠিত নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল এনএম ইলেকট্রনিকস। নিবন্ধনের জন্য দ্রুত নাম বাছাই করতে গিয়ে নিজেদের নামের আদ্যক্ষর থেকে এমন নাম। পরে ইন্টিগ্রেটেড ইলেকট্রনিকস শব্দ দুটির প্রথম অংশের সমন্বয়ে ইনটেল নামকরণ করা হয়।

নতুন সদস্য অ্যান্ডি গ্রুভ

নয়েচ ও মুরের একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। আর অসাধারণ দক্ষতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি অ্যান্ডি গ্রুভ নামের অপর একজনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন মুর।

অ্যান্ডিকে যখন মুর জানান যে বর্তমান চাকরি ছেড়ে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করছেন তাঁরা, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাঁদের দলে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে ইনটেলের সফলতার অন্যতম শক্তি ছিলেন অ্যান্ডি গ্রুভ।

স্টিফেন হকিংয়ের সাহায্যে ইনটেল

১৯৯৭ সালে প্রয়াত ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে দেখা হয় গর্ডন মুরের। মুর দেখলেন, হকিংয়ের কম্পিউটারে এএমডির প্রসেসর। এরপর থেকে আমৃত্যু হকিংয়ের কথা বলার সুবিধার জন্য কম্পিউটার ও প্রযুক্তি দিয়ে এসেছে ইনটেল।

বর্তমান ইনটেল

২০১৫ সালে ইনটেল যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে সরাসরি ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার এবং পরোক্ষভাবে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার  অবদান রাখে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ইনটেলের ৫০ হাজারের বেশি কারিগরি কর্মী রয়েছেন এবং সার্বিকভাবে ৫ লাখের বেশি মানুষ তাদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

মাইক্রোপ্রসেসর উৎপাদনের দিক থেকে ইনটেল বিশ্বের মধ্যে অন্যতম। প্রতি সেকেন্ডে ইনটেল ১ হাজার কোটি ট্রানজিস্টর উৎপাদন করে। প্রতিষ্ঠানটির গ্লোবাল ইনভেন্টরি থেকে প্রতি ২৪ সেকেন্ডে একটি শিপমেন্ট পাঠানো হয়। ইনটেলের এই চিপ উৎপাদন কারখানাগুলো বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন জায়গা। হাসপাতালের অপারেশন কক্ষগুলো সাধারণত অনেক পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে, কিন্তু ইনটেলের চিপ তৈরি কারখানাগুলোয় তার থেকেও অন্তত এক হাজার গুণ কম জীবাণু বা ধুলা থাকে।

ইনটেলের সবকিছুর মূলে উদ্ভাবন। কম্পিউটার চিপ থেকে শুরু হলেও বর্তমানে তারা আরও অনেক ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। ইনটেলের প্রায় সব উৎপাদন এবং উদ্ভাবন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকেই।

৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ইনটেল একটি বিশ্ব রেকর্ড করে, যেখানে তারা ৫০০টি স্বয়ংক্রিয় ড্রোনের মাধ্যমে একটি আলোক প্রদর্শনী দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ক্যালিফোর্নিয়ার প্রধান অফিসে এর আয়োজন করা হয়েছিল।

সূত্র: ইনটেল

ইনটেলের ১০টি উদ্ভাবন

৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইনটেল তাদের ৫০টি উদ্ভাবনের তালিকা তৈরি করে সব কর্মীকে তাঁদের পছন্দের ১০টি উদ্ভাবন নির্বাচন করতে অনুরোধ করে। প্রায় ২ হাজার ৬০০ কর্মী মতামত দিয়েছিলেন এবং তাঁদের নির্বাচিত ১০টি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনের তালিকা নিচে দেওয়া হলো।

১. এক্স৮৬ আর্কিটেকচার

১৯৭৮ সালে উদ্ভাবিত এই এক্স৮৬ হলো আগের আর্কিটেকচারগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন একটি নতুন ইনস্ট্রাকশন সেট, যা ইনটেল ৮০৮৬ সিপিইউর জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল। বর্তমান সময়ের প্রায় সব ল্যাপটপ, ডেস্কটপ এবং সার্ভার কম্পিউটারে এই এক্স৮৬ আর্কিটেকচার ব্যবহার করা হয়।

২. মুরের সূত্র

মুরের সূত্রে বলা হয়েছে যে একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটে প্রতি দুই বছরে দ্বিগুণ সংখ্যক ট্রানজিস্টার যুক্ত করা যাবে। ইনটেল প্রতিষ্ঠার অনেক দিন আগেই এই সূত্রটি তিনি জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো এ সূত্রটি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই অনেকটা ইনটেল নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

৩. ইউএসবি

প্লাগ অ্যান্ড প্লে! ইনটেল যৌথভাবে ইউনিভার্সাল সিরিয়াল বাস বা ইউএসবির মানটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর মাধ্যমে যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই যেকোনো যন্ত্রাংশ কম্পিউটারের সঙ্গে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে। ইনটেল ইউএসবি সমর্থন করে এমন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট প্রকাশ করে ১৯৯৫ সালে।

৪. ৮০৮০ প্রসেসর

ইনটেলের ৮০৮০ প্রসেসর বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মাইক্রোপ্রসেসর। যুগান্তকারী এই উদ্ভাবনটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। ৪০ পিনের এই প্রসেসর আগের ১৫ পিনের ৮০০৮ থেকে বেশি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছিল। বলা যেতে পারে প্রসেসরটি উদ্ভাবনের কারণে কোটি কোটি মানুষ ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহার করতে শুরু করে।

৫. ত্রিমাত্রিক ট্রাই-গেট ট্রানজিস্টর প্রযুক্তি

২০১১ সালে ইনটেল প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে ত্রিমাত্রিক ট্রাই-গেট ট্রানজিস্টর প্রকাশ করে। স্বল্প অপারেটিং ভোল্টেজ থেকে উচ্চ মাত্রার ফলাফল দেয় এই প্রযুক্তি। মুরের সূত্রটির আবারও সত্যতা প্রমাণিত হয়।

৬. ৪০০৪ প্রসেসর

১৯৭১ সালে প্রকাশ করা হয়। এটি মনোলিথিক সিপিইউ ছিল এবং একটি চিপের মধ্যে পূর্ণ ইন্টিগ্রেটেড অবস্থায় ছিল।

৭. পেন্টিয়াম প্রসেসর

১৯৯৩ সালে ৩১ লাখ ট্রানজিস্টরের সমন্বয়ে তৈরি এই প্রসেসর সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেবারই প্রথম ইনটেল নামকরণের ক্ষেত্রে সংখ্যার পরিবর্তে শব্দ ব্যবহার কর। ‘ইনটেল ইনসাইড’—স্লোগানটি দ্রুত পরিচিতি পায়।

৮. থ্রিডি এক্সপয়েন্ট

২০১৫ সালে ইনটেল ঘোষণা করে যে তারা থ্রিডি এক্সপয়েন্ট নামের একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এটি স্থায়ীভাবে তথ্য সংরক্ষণের একটি প্রযুক্তি, যা বর্তমানে প্রচলিত প্রযুক্তি থেকে অনেক গুণ দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারে। মাইক্রন সিস্টেমের সঙ্গে যৌথভাবে উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি পণ্যগুলো ইনটেল অপটেন ব্র্যান্ডের অধীনে বাজারজাত করা হয়।

৯. ইথারনেট

ইনটেল, ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট ও জেনন যৌথভাবে ইথারনেটের স্ট্যান্ডার্ড প্রতিষ্ঠা করে। এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক কম্পিউটার পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থেকে একটি লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক তৈরি করে।

১০. মাল্টিকোর আর্কিটেকচার

প্রসেসরে একাধিক কোরের মাধ্যমে কাজ করার ধারণাটি প্রথম ইনটেল প্রকাশ করে। ২০০৫ সালে মাল্টিকোর প্রসেসর উন্মুক্ত করার পর অন্য সব চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ ধারণাটি নিয়ে কাজ শুরু করে।