কাকে আঘাত করবে চালকবিহীন গাড়ি?

অলংকরণ: সাইমন ল্যানড্রেইন, এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত
অলংকরণ: সাইমন ল্যানড্রেইন, এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি মিডিয়া ল্যাবে জরিপের জন্য একটি গেম বানানো হয়। দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তের কিছু বর্ণনা দিয়ে ব্যবহারকারীকে বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে চালকবিহীন গাড়ি কী করবে, কাকে আঘাত হানবে। যন্ত্রের নৈতিকতার পরীক্ষা বলে গেমটির নাম দেওয়া হয় ‘মোরাল মেশিন’।

গত চার বছরে চার কোটির বেশিবার খেলা হয় গেমটি। পৃথিবীর ২৩৩টি এলাকার মানুষ জানিয়েছেন সংকটের মুহূর্তে চালকবিহীন গাড়ির কী করা উচিত। নৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর চালানো বড় জরিপগুলোর একটি এটি। চার বছর আগে নির্মাতারা চিন্তাও করেননি এমন সাড়া ফেলবে মোরাল মেশিন।

জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেল নৈতিক সিদ্ধান্ত নির্ভর করে একজন মানুষের সংস্কৃতি, তার অবস্থান, তার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। সেটা হোক তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করে চালকবিহীন গাড়ির মতো বিষয়। এমআইটির সে গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে নেচার সাময়িকীতে।

মোরাল মেশিনের পরীক্ষা অনেকটা সেই ট্রলি প্রবলেমের মতো। রেলপথ ধরে দুর্বার বেগে ধেয়ে আসছে ট্রলি। সামনে দুদিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে রেলপথ। একটি পথের ওপর পাঁচজন, অন্যটিতে একজন মানুষ। ট্রলিটি কোন পথে যাবে, মানে পথ পরিবর্তনের চাবি আছে একজনের হাতে। ট্রলির গতি এতই বেশি যে থামিয়ে বা পথ থেকে সরিয়ে মানুষ বাঁচানোর সুযোগ নেই। হয় একজন, নাহয় পাঁচজনের মৃত্যু হবে। চাবি আপনার হাতে, সিদ্ধান্ত আপনার—কোন পথে ট্রলি যাবে?

মোরাল মেশিনেও ট্রলি প্রবলেমের মতো নয়টি প্রশ্ন করা হয়েছে। পরিস্থিতির সচিত্র বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, একটি চালকবিহীন গাড়ি কাদের প্রাধান্য দেবে—মানুষ নাকি প্রাণী? যাত্রী নাকি পথচারী? কম নাকি বেশি মানুষ? উচ্চবিত্ত নাকি নিম্নবিত্ত? নারী নাকি পুরুষ? দুর্বল নাকি সবল? যুবক না বৃদ্ধ? আইন মান্যকারী নাকি অমান্যকারী? শেষমেশ যে পথে ছিল সে পথেই থাকবে, নাকি অবস্থা বুঝে পথ বদলে কিছু করার চেষ্টা করবে?

আবার এমন প্রশ্নও ছিল যে গাড়িটি কি সোজা চালিয়ে তিন বৃদ্ধ পথচারীকে ধাক্কা দেবে, নাকি বাঁক ঘুরে তিন যুবক যাত্রীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। এমন প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে উত্তরদাতার দেশে ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। যেমন চীন বা জাপানের মতো দেশের নাগরিক বৃদ্ধদের বাঁচানোর পক্ষে মত দিয়েছে। সেটা বয়োবৃদ্ধদের প্রতি তাদের সম্মানবোধের জন্যই।

বেপরোয়া হলেও পথচারীকে বাঁচানোর পক্ষে মত দিয়েছে তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলোর নাগরিকেরা। আর যেসব দেশের জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক তারতম্য প্রকট, তাদের উত্তরে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ব্যাপারটা এসেছে বেশি। আর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর নাগরিক অল্প মানুষের চেয়ে বেশি মানুষকে বাঁচানোর পক্ষে মত দিয়েছে। কাছাকাছি দেশের নাগরিকদের উত্তরে সাদৃশ্য বেশি। জরিপের ফলাফলে সামষ্টিক দিক থেকে পশ্চিম, পূর্ব আর দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে মানুষদের উত্তরে বৈচিত্র্য পাওয়া গেছে।

এমআইটির গবেষণাটির প্রয়োগগত গুণ রয়েছে। কারণ, যেসব দেশে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি ব্যবহার করা হবে এবং যেসব জায়গায় এসব গাড়ি তৈরি হবে সে দেশের সরকারপ্রধানেরা আইন প্রণয়নে বিবেচনায় আনতে পারবেন। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নৈতিকতার দিকটিকেও গবেষণাটি সাহায্য করবে বলে মনে করেন গবেষকেরা।

সূত্র: এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ