ইন্টারনেটে ভালো থাকুন

মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য এখন সবচেয়ে মূল্যবান। ইন্টারনেটভিত্তিক প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই তথ্য সংগ্রহের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সফটওয়্যার, অ্যাপ তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর এগুলোর মাধ্যমে কখনো সরাসরি, কখনো কৌশলে বা প্রতারণার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের কাজটি করা হয়ে থাকে।
ই-মেইল, অনলাইনে কেনাকাটা, ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিনোদন ও বিভিন্ন ধরনের কাজের মোবাইল অ্যাপের জনপ্রিয়তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

বর্তমানে প্রায় সব অ্যাপ, ওয়েবসাইট ও অ্যাপলিকেশনে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। নাম, ই-মেইল, ফোন নম্বর থেকে শুরু হলেও প্রোফাইল হালনাগাদ করার সময় ব্যক্তিগত আরও বহু তথ্য উল্লেখ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। ব্যবহারকারীর তথ্যগুলো কী কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তার বর্ণনা থাকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নীতিমালায়। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হলেই কেবল সেখানে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা এবং অ্যাপটি ব্যবহার করা উচিত। তবে বেশির ভাগ ব্যবহারকারী এই দীর্ঘ নীতিমালা পড়েন না। ইন্টারনেটে এমন সবকিছুর মধ্যেও নিরাপদ ও ভালো থাকতে কিছু ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।

প্রতিক্ষণে চেক-ইন
ফেসবুকসহ আরও বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অ্যাপে চেক-ইন দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। চেক-ইন হলো আপনি বর্তমানে কোন অবস্থানে আছেন, সেটি প্রকাশ করা। কিছু অ্যাপের বৈশিষ্ট্য এমন, যেখানে ব্যবহারকারীদের মধ্যে চেক-ইন দেওয়ার একটি প্রতিযোগিতার মতো সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে সবাই কিছুক্ষণ পরপরই সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি কোথায় আছেন এবং তাঁর সঙ্গে এখন কারা রয়েছেন। এই অবস্থান অনুসরণ করে যে কেউ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সমাধান: প্রতিনিয়ত নিজের অবস্থান সবাইকে জানানোর অভ্যাস থেকে সরে আসতে হবে। বিশেষ কোনো মুহূর্ত সবাইকে জানাতেই হলে সেই স্থানে না থাকা অবস্থায় হালনাগাদ জানানো যেতে পারে।

ক্ষতিকর অ্যাপ, ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার
কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন—যে যন্ত্রের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রথমে সেটির সুরক্ষা প্রয়োজন। যত সফটওয়্যার বা অ্যাপ ইনস্টল করা আছে, সেগুলো নির্দিষ্ট কী কী কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানা থাকতে হবে। নতুন কম্পিউটার কেনার পর না চাইতেই অনেক অনেক সফটওয়্যার ইনস্টল করে দেওয়া হয়, কিন্তু সেগুলোর কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সেটি জেনে নেওয়া উচিত।

সমাধান: ওয়েবসাইট দেখা অথবা অন্যান্য অ্যাপ ব্যবহার করার সময় বিজ্ঞাপনের মধ্যে বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফারসহ নতুন নতুন অ্যাপ ইনস্টল করার পরামর্শ দেওয়া হয়। নতুন যা কিছুই ইনস্টল করা হোক না কেন, ইনস্টল করার আগে সফটওয়্যারটি কী কাজের, সেটি খুঁজে দেখতে হবে। অজানা উৎস থেকে ইনস্টল করা হলে ক্ষতিকর কোনো প্রোগ্রাম ইনস্টল হয়ে যেতে পারে।

অ্যাকাউন্ট বেদখল হওয়া
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ছড়িয়ে দিই আমরা, সেগুলো জানার জন্য প্রতিনিয়তই চেষ্টা করছে বহুজন। তাই অ্যাকাউন্ট বেদখল (হ্যাকড) হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। অ্যাকাউন্ট উদ্ধারের অপশনগুলো ব্যবহার করেই অনেক সময় অপর কেউ অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।
সমাধান: অ্যাকাউন্ট নিরাপদ রাখার জন্য ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়েবসাইটের যেসব নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার সব, বিশেষত লগ–ইন অ্যালার্ট, এসএমএস ও ই-মেইল, দুই স্তরের নিরাপত্তা সক্রিয় রাখতে হবে। হ্যাকড হয়েছে বা অপর কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে মনে হলে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে অন্য নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলো পুনরায় যাচাই করতে হবে।

ইন্টারনেট ব্রাউজার ও অ্যাড-অন
মজিলা ফায়ারফক্স, গুগল ক্রোম ও ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার বা এজ ইন্টারনেট ব্রাউজারের পাশাপাশি আরও বহু ব্রাউজিং সফটওয়্যার পাওয়া যায়। কিন্তু দেখতে আকর্ষণীয় বা বিনা মূল্যে পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো নির্ভরযোগ্য না। ব্রাউজার থেকে কোন কোন ওয়েবসাইট দেখা হচ্ছে বা কোন কোন ওয়েবসাইটে লগইন করা হচ্ছে, সেগুলো রেকর্ড করে সেসবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলতে পারে। একইভাবে ব্রাউজারে অতিরিক্ত অ্যাডঅন ও এক্সটেনশনের মাধ্যমেও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
সমাধান: ব্রাউজার নির্বাচনের সময় সতর্কতা প্রয়োজন। কারণ, এই সফটওয়্যারের মাধ্যমেই ইন্টারনেটে সব ধরনের কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। অপর কোনো ওয়েবসাইট বা ব্যক্তির পরামর্শমতো অ্যাডঅন ব্যবহার শুরু করার আগে নিশ্চিতভাবে জেনে নেওয়া উচিত এটি কী কাজে ব্যবহার করা হবে।

পাইরেটেড সফটওয়্যার ও অ্যাপ
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম বড় মাধ্যম হলো পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার। মূল সফটওয়্যারের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় এই পাইরেটেড সফটওয়্যার। এর ফলে এই সফটওয়্যার ইন্টারনেটযুক্ত কোনো কম্পিউটারে চালু করা হলে, অপর কেউ এই কম্পিউটারে প্রবেশ করছে কি না, সেটা জানার সুযোগ নেই।
সমাধান: মূল সফটওয়্যারটি বিনা মূল্যে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে অনেকেই পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এই বিনা মূল্যে পাওয়ার জন্য তাঁর আরও কী কী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বা হয়ে যেতে পারে, তা ভেবে দেখেন না। পাইরেসি একটি অনৈতিক ও বেআইনি কাজ, পাশাপাশি ব্যক্তিগত ক্ষতির দিকগুলো তো রয়েছেই। কিনে ব্যবহার করা আয়ত্তের বাইরে হলে অন্যান্য ওপেন সোর্স ও ফ্রি সফটওয়্যার থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নেওয়া যেতে পারে।

পাবলিক ওয়াই-ফাই
পাবলিক ও ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে কোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপে লগইন করা হলে তথ্য চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সমাধান: এ ধরনের পদ্ধতিতে ইন্টারনেট ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত। আর যদি ব্যবহার করা হয় তবে খেয়াল রাখতে হবে ওয়েবসাইটের ঠিকানার শুরুতে https:// লেখা আছে কি না।

মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য চুরি
মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ফোনে সংরক্ষিত সব ধরনের তথ্য—যেমন ফোন নম্বর, এসএমএস, ছবিসহ ফোন–সংক্রান্ত সব তথ্য চুরি করে নেওয়া যেতে পারে। অচেনা–অপরিচিত অ্যাপ ছাড়াও নিয়মিত ব্যবহারের দেশি প্রতিষ্ঠানের তৈরি অ্যাপের মাধ্যমেও এই ঘটনা ঘটেছে। তাই সব সময়ই সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
সমাধান: কোনো অ্যাপের মাধ্যমে এভাবে তথ্য চুরি হয়, জানার পর সঙ্গে সঙ্গেই সেটি আনইনস্টল করে ফেলা উচিত এবং গুগল প্লে এবং অ্যাপ স্টোরে এই বিষয়ে রিপোর্ট করা প্রয়োজন।

ফেসবুক অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য চুরি
‘বয়স বাড়লে আপনার চেহারা কেমন হবে?’, ‘আপনি কত দিন বাঁচবেন?’, ‘আপনার বন্ধু তালিকার কে আপনাকে পছন্দ করে?’, ‘কবে বিয়ে হবে?’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে প্রতিদিনই বিভিন্ন অ্যাপ প্রকাশ পাচ্ছে। নির্ভরযোগ্য নয় জানার পরও বহু ব্যবহারকারী নিছক আনন্দের জন্য এই সব তথ্য জানাতে অজ্ঞতাবশত নিজ এবং বন্ধু তালিকার সবার তথ্য ওই সব অ্যাপে আপলোড করে দিচ্ছেন। প্রায় সময়ই এই সব অ্যাপে বলা হয়, আপনি যত বেশি তথ্য সংযোজন করবেন, এই ভবিষ্যদ্বাণী তত বেশি নির্ভুল হবে। সেই আশাতেও আরও তথ্য সংযোজনের চেষ্টা করেন অনেকেই।

সমাধান: এসব অ্যাপ তৈরির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নেওয়া। এবং যে ভবিষ্যদ্বাণী প্রদর্শন করা হয়, সেগুলোও ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক। অপরদিকে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো অ্যাপ নির্মাতারা কীভাবে ব্যবহার করছেন, তা জানারও সুযোগ নেই। তাই আপনার অজান্তেই নিজের ও অপরের ক্ষতি হতে পারে, এমন কাজ থেকে দূরে সরে থাকতে হবে।
ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে সচেতনতা প্রয়োজন নিজের নিরাপত্তার জন্যই। আবার কখনো কখনো তথ্য অপরের কাছে চলে গেলে পরিবার ও বন্ধুরাও এর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। ইন্টারনেট একটি উন্মুক্ত পরিসর, প্রতিটি কাজ করার সময়ই সতর্কতা প্রয়োজন। বর্তমানের সব ধরনের কাজের সঙ্গেই ইন্টারনেট যুক্ত হচ্ছে এবং এটি ক্রমেই বাড়ছে। নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যত বেশি ও যত দ্রুত জানা যাবে, নিজে এবং আশপাশের প্রিয় মানুষগুলো তত বেশি নিরাপদ থাকবে।
লেখক: সফটওয়্যার প্রকৌশলী