দুবাই পুলিশের যত প্রযুক্তি

>সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি শহর হলেও দুবাইয়ের আলাদা পরিচিতি আছে। একইভাবে গোটা বিশ্বের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে দুবাইয়ের পুলিশ অনন্য। বিলাসবহুল সব গাড়ি নিয়ে তাদের দুবাইয়ের পথে পথে দেখা যায়। সর্বশেষ প্রযুক্তির ব্যবহারেও তাদের জুড়ি নেই। দুবাই পুলিশের প্রযুক্তি নিয়ে জানাচ্ছেন শাওন খান

জলে যেমন, স্থলেও তেমন

দুবাই পুলিশের বিশেষ সদস্যদের যে বিলাসবহুল সুপারকার রয়েছে, সেটা অনেকেরই জানা। তবে তাঁদের এমন গাড়িও আছে, যা রাস্তা আর পানিতে সমান তালে চলতে পারে। দুবাইয়ের পুলিশ বাহিনীতে উভচর গাড়ি যুক্ত হয় ২০১৪ সালে। উভচর এই গাড়িগুলো রাস্তা থেকে পানিতে নামানোর জন্য থামানোর প্রয়োজন নেই। চলতে চলতেই রাস্তা শেষে পানিতে নামিয়ে দিলে এক বিশেষ সেন্সর গাড়িটিকে পানিতে ভাসমান ও চলমান করে তোলে। কে জানে, চোর ভাগতে গিয়ে যদি রাস্তা থেকে পানিতে নেমে পড়ে? তাই হয়তো আগে থেকেই এই ব্যবস্থা দুবাই পুলিশের।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

এ বছরের এপ্রিলে ১০ জনের একটি চক্র দুবাইয়ের একজন বিটকয়েন বিক্রেতার কাছ থেকে প্রায় ১৯ লাখ মার্কিন ডলার ডাকাতি করে নিয়ে যায়। দুবাই পুলিশকে এই ডাকাতির বিষয়ে অভিযোগ করা হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনটি আলাদা জায়গা থেকে পুরো চক্র হাতিয়ে নেওয়া অর্থসহ ধরা পড়ে। আর এ খবরেই সবার টনক নড়ে যায়। এত কম সময়ে পুরো একটি চক্রকে আটক করা কীভাবে সম্ভব হলো? তখনই সামনে আসে দুবাই পুলিশের অপরাধী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের কথা। তথ্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণে বেশ কয়েক বছর ধরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির ব্যবহার করছে দুবাই পুলিশ। তাদের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এ প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১০৯ জন লুকিয়ে থাকা অপরাধীকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও প্রায় ৪৪১ জন বিভিন্ন অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ প্রযুক্তিতে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মুখাবয়ব শনাক্তকরণ সুবিধাও রয়েছে।

রোবট পুলিশ

পর্দায় যেমন রোবোকপ আছে, পর্দার বাইরেও আছে। দুবাই পুলিশ বাহিনীতে গত বছর রোবোকপ নামে একধরনের বিশেষ রোবট পুলিশ যোগ করা হয়। চলচ্চিত্রের রোবোকপের মতো দুবাইয়ের রোবোকপ তেমন শক্তিশালী নয়। তবে দুবাই পুলিশের রোবোকপ অপরাধী শনাক্ত করতে ও সংঘটিত অপরাধের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। মূলত দুবাইয়ের ব্যস্ত স্থানগুলোতে নজরদারি করতে ব্যবহার করা হবে এই রোবট পুলিশ। আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে দুবাইয়ের বিশেষ বিশেষ স্থানে কর্তব্যরত আছে রোবোকপ। গবেষণায় সফল হলে ২০৩০ সাল নাগাদ দুবাই পুলিশের ২৫ শতাংশই হবে রোবট পুলিশ।

 চালকবিহীন ভ্রাম্যমাণ থানা

ভ্রাম্যমাণ আদালতের কথা তো শুনেছেন অনেকই, দেখেও থাকবেন কেউ কেউ। ঘটনাস্থলেই মামলা, বিচার আর জরিমানা আদায়—সব হয়ে যায়। দুবাইয়েও আছে। তবে সেটা আদালত নয়, থানা। সেই থানাতে আবার কোনো পুলিশ নেই। থানায় গিয়ে সাধারণ যা কিছু করা যায়, সবই করা যায় দুবাইয়ের চালকবিহীন ভ্রাম্যমাণ থানায়। দুবাই পুলিশের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের এ আরেক নমুনা। মিনিবাস আকৃতির এই চালকবিহীন ও পুলিশবিহীন থানাটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে চলে। প্রয়োজন পড়লে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় এই ভ্রাম্যমাণ থানা। ঘটনার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, ভুক্তভোগীর অভিযোগ গ্রহণসহ সাধারণ জরিমানাও আদায় করতে সক্ষম এই চালকবিহীন ভ্রাম্যমাণ থানা।

 উড়েই আসবে পুলিশ

উড়ন্ত মোটরবাইকে চড়ে উড়ে উড়ে শহরময় টহল দেবে দুবাই পুলিশ। শুরু হয়েছে প্রশিক্ষণও। দুবাই পুলিশ সদস্যদের দুটি বিশেষ দলকে হোভারসার্ফ এস৩ নামের উড়ন্ত মোটরবাইক পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে দুবাইয়ে হয়তো যখনতখন দেখা যাবে উড়ন্ত পুলিশ বাহিনী।

হোভারসার্ফ এস৩ হলো হোভারবাইক। চলে বিদ্যুতে। হোভারবাইকটি মাটি থেকে যেকোনো দিকে উড়ে যেতে পারে। তবে যানজটে আটকা পড়ার ভয়ে নয়, বরং দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছাতে ব্যবহার করা হবে হোভারবাইক।

দুবাই পুলিশের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এই হোভারবাইক মাটি থেকে প্রায় ১৬ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে যেতে পারবে। ওজন প্রায় ১১৪ কেজি। আর গতিও দুর্দান্ত। হোভারবাইকটি ঘণ্টায় প্রায় ৯৭ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। একবার পূর্ণ চার্জে একজন চালকসহ হোভারবাইকটি টানা ১০ থেকে ২৫ মিনিটের বেশি উড়তে পারে না। কার্বন ফাইবারে তৈরি হোভারবাইকটির দাম প্রায় দেড় লাখ ডলার।

স্মার্ট পুলিশ স্টেশন

দুবাই পুলিশের শুধু চালকবিহীন ভ্রাম্যমাণ থানাটিই আধুনিক প্রযুক্তির নয়, তাদের থানাও প্রযুক্তির সর্বোচ্চটাই ব্যবহার করে। দুবাইকে বিশ্বের সবচেয়ে স্মার্ট শহর গড়ে তোলার প্রকল্পের আওতায় এই শহরের থানাগুলোকেও স্মার্ট করা হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে বিশ্বের প্রথম এই স্মার্ট পুলিশ স্টেশন (এসপিএস) চালু করে দুবাই পুলিশ। আর এই এসপিএসও পুলিশবিহীন ভার্চ্যুয়াল একটি থানা। দুবাইয়ের বাসিন্দা ও পর্যটকদের দ্রুত ও সহজতর উপায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পুলিশি সেবা দিতে চালু করা হয় এই স্মার্ট থানা। এই স্মার্ট থানা মূলত অনলাইনভিত্তিক, তবে সশরীর উপস্থিত হওয়ার জন্য বাস্তবেও রয়েছে এই থানা। দুবাই পুলিশের এসপিএস অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনগণ নতুন অভিযোগ ও তথ্য দেওয়া, আগের অভিযোগের অবস্থা জানা, ট্রাফিক জরিমানা প্রদান করা, চুরি বা হারিয়ে যাওয়া পণ্যের কিংবা সন্দেহজনক কোনো কর্মকাণ্ডের তথ্য দেওয়াসহ সরাসরি পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথাও বলা যাবে এই স্মার্ট থানার মাধ্যমে। তবে কোনো অপরাধের অভিযোগ জানানোকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় এই থানা। ২০২১ সাল নাগাদ গোটা দুবাইয়ে এসপিএস চালু করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।