ইউরোপীয় ইউনিয়নের লৌহমানবী

চুলে পিক্সি ধাঁচের ছাঁট। পোশাক ফ্যাশনদুরস্ত। কথাবার্তায় বেশ আন্তরিক। বেরসিক তো ননই। চেহারাও হাস্যোজ্জ্বল। তবু মারগ্রেথে ভেস্তাগের সম্পর্কে টাইম সাময়িকী লিখল ‘লৌহমানবী’। তা অবশ্য মোটেও ভুল লেখেনি। প্রয়োজনে তাঁকে লোহার মতোই শক্ত হতে দেখেছে প্রযুক্তিবিশ্ব।
মারগ্রেথে ভেস্তাগেরের পরিচয় তিনি ডেনমার্কের রাজনীতিবিদ। বিভিন্ন সময়ে দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। এরপর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কম্পিটিশন কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হন। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা ঠেকাতে কাজ করে যাচ্ছেন। ইউরোপের বাজারে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো অসম প্রতিযোগিতার চেষ্টা করবে, কর ফাঁকি দেবে বা ভোক্তাকে ঠকিয়ে লাভের মুখ দেখবে আর তা মারগ্রেথে ভেস্তাগেরের চোখ এড়িয়ে যাবে, এমনটা হয় না। আর সে কারণেই গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, কোয়ালকমের মতো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা তাঁকে সমঝে চলে।

খড়্গহস্ত মারগ্রেথে ভেস্তাগের
কম্পিটিশন কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের চুলচেরা বিশ্লেষণে লেগে পড়েন। প্রথম চোখ পড়ে গুগলের ওপর। নিজেদের পণ্য ও সেবার প্রসার এবং অন্য প্রতিযোগীরা যাতে বাজারে জায়গা করতে না পারে, সে জন্য গুগল তাদের সার্চ ইঞ্জিনের অ্যালগরিদমের অপব্যবহার করছে, এমন অভিযোগ উঠেছিল। তা ছাড়া সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারকারীদের অনুসন্ধান করা তথ্য সংরক্ষণ করে রাখত গুগল। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সার্চ অ্যালগরিদম ব্যবহার করার অভিযোগে ভেস্তাগের ও তাঁর দল অনুসন্ধান চালায় এবং ২০১৭ সালের জুলাইয়ে গুগলকে ২৭০ কোটি ডলার জরিমানা করে।

প্রায় দুই বছর ধরে অনুসন্ধানের পর ২০১৬ সালের আগস্টে মারগ্রেথে বলেন, আয়ারল্যান্ডে অযৌক্তিকভাবে কর ফাঁকি দিয়েছে অ্যাপল ইনকরপোরেটেড। তাঁর তত্ত্বাবধানে কম্পিটিশন কমিশন প্রায় ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার এবং এর থেকে যা সুদ আসবে, তা-সহ জরিমানা করে। ইতিহাসে এটিই এককভাবে কর নিয়ে করা সবচেয়ে বড় জরিমানা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুঠোফোন চিপ নির্মাতা কোয়ালকমও ফাঁকি দিতে পারেনি। কোয়ালকমের বিরুদ্ধে অভিযোগ—অ্যাপলের আইফোনে কোয়ালকমের চিপ ব্যবহার করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থ প্রদান করেছিল, যাতে প্রতিযোগিতায় কোয়ালকম এগিয়ে থাকে। আর অন্যান্য চিপ নির্মাতার গুণগত মান যেমনই হোক না কেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে। মারগ্রেথের ভাষ্য, কোয়ালকম এভাবে প্রায় পাঁচ বছর প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমিয়ে রেখেছিল। এ জন্য এ বছরের জানুয়ারিতে কমিশনটি কোয়ালকমকে প্রায় ১২০ কোটি ডলার জরিমানা করে।
ভেস্তাগের ২০১৪ সালে ফেসবুকের মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের বিষয়েও তদন্ত করেন। প্রাথমিকভাবে ফেসবুকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ—দুই সেবার মধ্যে তথ্য ভাগাভাগি করা হবে না। কিন্তু পরে ২০১৬ সালের আগস্টে অ্যাপ হালনাগাদের মাধ্যমে বিষয়টি চালু করে এবং আরও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করে। ফলে কম্পিটিশন কমিশন ফেসবুকের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগ আনে এবং প্রায় ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার জরিমানা করে।
মারগ্রেথে আমাজনের বিষয়েও অনুসন্ধান চালান। সেখানেও কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয় উঠে আসে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে ২৯ কোটি ২০ লাখ ডলার জরিমানা করেন।

ব্যক্তিজীবনে প্রযুক্তি
প্রযুক্তি বিষয়ে মারগ্রেথেকে বেশ সচেতন বলা যায়। তিনি দুটো মুঠোফোন ব্যবহার করেন। একটি ব্যক্তিগত কাজে, অন্যটি কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। সব ক্ষেত্রেই অবস্থান বা লোকেশন সেবা বন্ধ করে রাখেন। এদিকে যে গুগলকে জরিমানা করেছেন, ওয়েবে তথ্য খোঁজার জন্য সেই গুগলের ওপর ভরসা রাখতে পারেন না। মুঠোফোনে তাই তিনি ডাকডাকগো নামের একটি সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করেন। ভেস্তাগেরের ফেসবুক পাতা নেই। ২০১৭ সালে যখন তিনি ফেসবুকের নীতিমালা পড়েন, এরপর বেশ নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় তাঁর মনে।

সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়ার্ড, ইনভেস্টোপিডিয়া