বেড়েছে গাড়ির হাটে হাঁটাহাঁটি

বিএমডব্লিউ
বিএমডব্লিউ

‘গাড়ি পোষা আর হাতি পোষা সমান’—একবিংশ শতকেও এমন বদ্ধমূল ধারণা অনেকেরই। সময় বদলাচ্ছে; ব্যবহারকারীরা ব্যক্তিগত গাড়িকে বিলাসিতার অংশ হিসেবে মানতে নারাজ। পরিবার ও নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি এখন উপার্জনের মাধ্যমও বটে। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ, জিপিএসের মাধ্যমে গাড়ির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, হাতের কাছেই গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি—২০১৮ সালে বেশ আলোচনায় ছিল। গাড়ি বিক্রিও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এ বছর। ছোট পুঁজির ব্যবসা হিসেবে গাড়ি ভাড়াও জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রমেই।

টয়োটা ক্যামরি
টয়োটা ক্যামরি


টয়োটা এগিয়ে

জাপানের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটার গাড়ির চাহিদা অন্যান্য গাড়ির তুলনায় সব সময়ই বেশি। এই প্রতিষ্ঠানের নির্মিত গাড়ি দেশের অটোমোবাইল বাজার বা রাস্তাঘাটের ৮৫ শতাংশ গাড়ির চাহিদা পূরণ করে। ২০১৭ পর্যন্ত টয়োটার ভালো মানের সেডান হিসেবে প্রিমিও এবং এলিয়নের ২০১২-২০১৬ মডেলের গাড়িগুলো জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে টয়োটার বিলাসবহুল হাইব্রিড গাড়ি কেমরি সরকারি এবং বেসরকারি ব্যবহারকারীদের মন জুগিয়েছে। এ বছরের জনপ্রিয় গাড়ির তালিকায় টয়োটা প্রিয়াস, অ্যাকুয়া, এক্সিউ ও ফিল্ডার হাইব্রিড রয়েছে। বরাবরের মতো বেশি মালামাল বহনের জন্য টয়োটা প্রোবক্স সাশ্রয়ী মূল্যে একটি সেডান কার। এ ছাড়া হাফ ভ্যান বা মাইক্রো সেগমেন্টে টয়োটা এক্স নোয়াহ এসআই, স্কয়ার, ভক্সি, ভেলফায়ার ও অ্যালফার্ডের বিক্রি বেড়েছে। নতুন নকশার টয়োটা সিয়েন্টাও ক্রেতাদের চোখ আকর্ষণ করেছে। এই মডেলের গাড়িগুলোর হাইব্রিড এবং নন–হাইব্রিড দুটি সংস্করণই রয়েছে। আকারে ছোট এবং কম সিসির গাড়ির মধ্যে টয়োটা ভিটজ, আইএসটি ও পেসোর চাহিদা রয়েছে।

শেষ ভাগে বিক্রি কম

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রভাবে ২০১৮ সালের শেষ দিকে গাড়ি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় বলে জানান বিক্রেতারা। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডি অটোস বিডির ব্যবস্থাপনা অংশীদার রেশাদ করিম বলেন, ‘২০১৭ সালে আমাদের প্রতিমাসে ৬০টির বেশি গাড়ি বিক্রি হতো। সে হিসেবে প্রতিবছর আমরা ৭০০ থেকে ৭৫০টি গাড়ি বিক্রি করি। ২০১৮ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তখন আমরা প্রায় ২৫০টির বেশি গাড়ি বছরের প্রথমার্ধে বিক্রি করি। তবে বছরের শেষের দিকে নির্বাচন প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে গাড়ি বিক্রি কমতে থাকে। বেশি বিক্রীত গাড়ির তালিকায় টয়োটার ২০১৬ মডেলের নিউ শেপের প্রিমিও উল্লেখযোগ্য। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ডিজাইনের পাশাপাশি ক্রেতারা গাড়ির ফিচারের ব্যাপারেও আগ্রহী থাকেন।’

মিতসুবিশি পিএইচইভি আউটল্যান্ডার
মিতসুবিশি পিএইচইভি আউটল্যান্ডার


রিকন্ডিশনড গাড়ির বাজার বড়

টয়োটার পাশাপাশি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারে হোন্ডার জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। ক্রসওভার ঘরানায় হোন্ডা ভেজেল হাইব্রিড এ বছর বেশি বিক্রীত হওয়া গাড়িগুলোর একটি। সেডানে হোন্ডা গ্রেসও ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। হোন্ডা গ্রেস দামে টয়োটা এক্সিউ গাড়ির চেয়ে একটু বেশি হলেও এতে প্রিমিয়াম মানের সুবিধা রয়েছে। এ বছর জনপ্রিয় হওয়া অন্য আরেকটি গাড়ি হলো নিশান এক্সট্রেইল। এসইউভি ঘরানার গাড়িটি দেখতে যত আকর্ষণীয়, চড়তেও ততটা আরামদায়ক। বিলাসবহুল সারিতে টয়োটা হ্যারিয়ার, লেক্সাস, মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্টসসহ অন্যান্য গাড়িও বাজার দখল করেছে।

একটা সময় কয়েকটি নির্দিষ্ট মডেলের গাড়ি ছাড়া দেশের বাজারে অন্য গাড়ি তেমন দেখা যেত না। কিন্তু ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা এখন নিত্যনতুন মডেলের গাড়িগুলো কেনার ব্যাপারেও মনোযোগী হচ্ছে। টয়োটা ছাড়াও হোন্ডা, মিতসুবিশি, নিশান ও সুজুকি গাড়ির আকর্ষণীয় মডেলগুলো রাজধানীর রাস্তায় নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। গাড়িপ্রেমীরাও নিজেদের রুচির পরিবর্তন করছেন। ‘২০১৭ সালে আমরা ২৫০টির বেশি গাড়ি বিক্রি করি। ২০১৮ তে এসে যা বেড়ে ৪৫০ হয়েছে।’ জানালেন মেভেন অটোসের স্বত্বাধিকারী আশফাক ইবনে আবদুল আওয়াল।

২০১৮–এর প্রথম দিকে গাড়ি বিক্রিতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সন্তুষ্ট থাকলেও বছরের শেষের দিকে তাদের হতাশা বেড়েছে। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সালসাবিল কারের মহাব্যবস্থাপক মনিরুল আলম বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০১৭ থেকে ২০১৮ তে আমাদের বিক্রি কমেছে। নির্বাচনের বছর হওয়ায় অনেক ক্রেতা এ বছর গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছেন। বিক্রির দিক থেকে আমরা টয়োটা গাড়ি বেশি বিক্রি করে থাকি।’

এক্সিও হাইব্রিড
এক্সিও হাইব্রিড


বিলাসবহুল গাড়ি আসছে

২০১৮ সালে বিলাসবহুল ঘরানায় হাইব্রিড প্লাগ–ইন আনকোরা (ব্র্যান্ড নিউ) গাড়ি নিয়ে এসেছে বিএমডব্লিউ। মার্সিডিজ বেঞ্জ, অডি, কিয়া, মিতসুবিশি, হোন্ডা, টয়োটা, নিশান, হুন্দাই, ফোর্ড, পুঁজো, হাভাল, মাহিন্দ্রা, টাটাসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ‘ব্র্যান্ড নিউ’ অবস্থায় বাংলাদেশে আসে। দেশে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির বাজার এখনো ছোট হলেও প্রতিবছর নতুন গাড়ির চাহিদা বাড়ছে বলে জানান বিএমডব্লিউর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এক্সিকিউটিভ মোটরস লিমিটেডের পরিচালন বিভাগের পরিচালক দেওয়ান মুহাম্মদ সাজিদ আফজাল।

জাপানি ছাড়াও রয়েছে

জাপান ছাড়াও গাড়ি উৎপাদনকারী বেশ কয়েকটি দেশের (যেমন জার্মানি, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত) অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির বাজার দখল করেছে। পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে পুরাতন গাড়ি বেচাকেনার সারিতে টয়োটা এক্স করোলার চাহিদা তুঙ্গে। টয়োটার সবচেয়ে জনপ্রিয় এই গাড়ি পুরোনো অবস্থায় এখনো ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। পুরাতন গাড়ি বেচাকেনার জন্য রাজধানীতে কয়েকটি হাটের পাশাপাশি অনলাইন বাজারও রয়েছে। পুরাতন গাড়ির দোকানে গাড়ি বিক্রেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করেন বলে জানান পুরাতন গাড়ি ব্যবসায়ী এফ কে আশিক।

বছর শেষে আগের বছরের গাড়ির মডেলের ওপর শুল্ক কমে যাওয়ায় গাড়ি বিক্রি বেড়ে যায়। তবে এ বছর বিক্রিতে ভাটা পড়েছে বলেও জানান গাড়ি আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। তারপরও ২০১৮ সালে গাড়ি নিবন্ধনের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।