সানির ব্যাটারি বিপ্লব

সানি সানওয়ার
সানি সানওয়ার
সানি সানওয়ার কাজ করেন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন কার্বন নিঃসরণমুক্ত বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার। যুক্তরাষ্ট্রে নিজের প্রতিষ্ঠান ভার্ড টু গোয়ের মাধ্যমে তৈরি করেছেন লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি প্যাক। এই উদ্যোগের জন্যই বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস–এর ৩০ আন্ডার ৩০ তালিকার এনার্জি বিভাগে স্থান পেয়েছেন তিনি। সানি সানওয়ারকে নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। লিখেছেন পল্লব মোহাইমেন


৩ জানুয়ারি রাতে মুঠোফোনে সানি সানওয়ারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসে। বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ‘কয়েক ঘণ্টা পরেই ফ্লাইট। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৫ জানুয়ারি হয়ে যাবে।’

১৫ বছর বয়সে সানি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। এখন যে কাজটি করছেন, যে কাজের জন্য বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস–এর থার্টি আন্ডার থার্টি: ২০১৯ তালিকায় স্থান পেলেন সানি—সেটির চিন্তার শিকড় বাংলাদেশ থেকেই। ‘কম বয়স থেকেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে ভাবতে থাকি। কার্বন নিঃসরণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ জন্য আমার চিন্তা সব সময় কাজ করে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ নিয়ে।’

গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ফোর্বস ‘তিরিশের নিচে তিরিশ’ তালিকা প্রকাশ করে। সে সময়ই ই–মেইলে প্রথম যোগাযোগ হয় ২৮ বছর বয়সী সানি সানওয়ারের সঙ্গে। এর পর ধীরে ধীরে জানা হয় তাঁর সম্পর্কে, তাঁর কাজের ব্যাপারে।

লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি প্যাকের নানাররকম ব্যবহার। ছবি: ভার্ড টু গো
লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি প্যাকের নানাররকম ব্যবহার। ছবি: ভার্ড টু গো

সানির ভাষ্যে, লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি জীবাশ্মনির্ভর বিদ্যুৎ শক্তিকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর করতে বড় ভূমিকা রাখবে। এই ব্যাটারিগুলোর বাণিজ্যিক উৎপাদন এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সানির প্রতিষ্ঠান ভার্ড টু গোর ওয়েবসাইটে রাখা একটি ভিডিওতে এই ব্যাটারির কাজকর্মও দেখা গেল। পেট্রলপাম্প, গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি চলছে এই ব্যাটারির বিদ্যুতে।

ব্যাটারি প্যাক, মানে একাধিক ব্যাটারির সমন্বয়। ভার্ড টু গোর ওয়েবসাইটে ব্যাটারি প্যাক সম্পর্কে লেখা আছে পোর্টেবল, স্টোরেবল, শেয়ারেবল, ট্র্যাকেবল। সানি বললেন, ‘এ ফোর কাগজের প্যাকেটের মতো আকার একেকটি ব্যাটারির। ওজন সাড়ে ছয় কেজি। প্রতিটি ব্যাটারির ক্ষমতা ৮০০ ওয়াট–আওয়ার।’ মানে পাঁচটা ব্যাটারি যোগ করলেই পাওয়া যাচ্ছে প্রায় চার কিলোওয়াট–আওয়ার। আরও বেশি ব্যাটারি, আরও বেশি ওয়াট। চাইলে ছোটখাটো বিদ্যুৎকেন্দ্র সহজেই বানিয়ে ফেলা যায় সানির ব্যাটারি দিয়ে। সানি যোগ করেন, ‘একটা ব্যাটারি দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ একটি বাড়ির বিদ্যুতের জোগান দেওয়া যাবে। দিনের বেলা সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করবে আর রাতে জমানো বিদ্যুৎ খরচ করবে।’

নবায়নযোগ্য বলেই সৌরশক্তি এই লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি প্যাক সোলার প্যানেল থেকে চার্জড হবে। আবার বায়ু বিদ্যুৎ বা গ্যাস ব্যবহার করেও এই ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ জমানো যাবে। নিজের নকশাতেই সানি তৈরি করেছেন ব্যাটারি প্যাক। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য ব্যাটারিগুলো এখন তৈরি হচ্ছে মিজৌরির একটা কারখানায়। সিসানির্ভর প্রচলিত ব্যাটারির চেয়ে লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি আকারে চার গুণ ছোট, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে পাঁচ গুণ বেশি।

স্ত্রী ব্রিয়ানার সঙ্গে
স্ত্রী ব্রিয়ানার সঙ্গে

সানি সানওয়ারের আদি বাড়ি নাটোরের শিংড়া। তবে জন্ম ঢাকায়, ১৯৮৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাবা সারওয়ার আজম বুয়েট থেকে পাশ করা যন্ত্র প্রকৌশলী। কাজ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবিতে, অবসর নিয়েছন কর্নেল হিসেবে। মা কামরুন নাহার ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণা করেন। একমাত্র বোন সাজিয়া সারওয়ার স্থপতি, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। অ্যারিজোনা িবশ্ববিদ্যালয় েথকে স্নাতকোত্তর পড়ার পর এখন িনউইয়র্ক স্টেট ইউনির্ভািসটিতে শিক্ষাকতা করছেন। ২০১৭ সালে সানি বিয়ে করেছেন। স্ত্রী ব্রিয়ানা সানওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস সিটির একটি হাসপাতালে সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সানির জীবনে সবকিছুই একটু আগেভাগেই এসেছে। ফোর্বস সাময়িকীতে তাঁর সম্পর্কে লেখা সংশাবচনে বলা হয়েছে—সানি বেশ কম বয়সে যন্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন। ১৩–১৪ বছর বয়সে ২০০৫ সালে সানি মার্কিন সরকারের একটি বিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার আগে ঢাকায় বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়তেন। যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য মূল্যায়ন পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। লিঙ্কন কলেজ প্রিপারেটরি একাডেমি তাঁকে ভর্তি করে দ্বাদশ শ্রেণিতে। এরপর ১৯ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাস থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক হন। পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন ইউনিভার্সটি অব মিজৌরি ইন ক্যানসাস সিটি থেকে। সেখান থেকেই পিএইচডি করেন এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ও উদ্ভাবন বিষয়ে। পিএইচডির মূল বিষয় এই বিদুৎ শক্তির ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

প্রযুক্তি নিয়ে সানির পড়াশোনার আগ্রহের মূলে আছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিফতাহুর রহমান। কিশোর বয়সে তাঁর ম্যাটল্যাব কম্পিউটার প্রকল্পে কিছুদিন কাজ করেছিলেন সানি। সেখানেই আগ্রহ জন্ম প্রযুক্তির প্রতি। ২০১৩ সালে ভার্ড টু গো যখন প্রতিষ্ঠা করেন সানি তখন একাই ছিলেন। ১৫ সালে যুক্ত করেন তিনজন প্রকৌশলীকে। আর ১৭–তে এসে দুজন বিপণনকর্মী যোগ দেন এ প্রতিষ্ঠানে। এখন সানি একটি সফটওয়্যার বানাচ্ছেন, যেটি বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবস্থাপনায় কাজ করবে।

বাবা, মা ও বোনের সঙ্গে সানি সানওয়ার। ছবি: সংগৃহীত
বাবা, মা ও বোনের সঙ্গে সানি সানওয়ার। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৌশলী সানি সানওয়ারের শখ ছবি আঁকা। বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি আঁকেন তেলরং ও অ্যাক্রিলিকে। ২০১২ সালে সানির আঁকা কিছু প্রতিকৃতি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি প্রদর্শনীও হয়েছে। সবকিছুর পর সানির চিন্তা, পরিকল্পনা পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ শক্তি নিয়ে। ভবিষ্যতে চান পৃথিবীর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে। বাংলাদেশেও এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন, কিছু কিছু প্রকল্প বাস্তবরূপ পাবে হয়তো অদূরভবিষ্যতে। সানি বাংলাদেশ গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা (২০১১)। সানি মনে করেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীর বিশালবিপুল সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করা যাবে। গড়ে তোলা যাবে পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য এক সুন্দর পৃথিবী।