মেড ইন বাংলাদেশ

দেশের কারখানায় মোবাইল ফোন সংযোজন করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
দেশের কারখানায় মোবাইল ফোন সংযোজন করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ল্যাপটপ কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও আইওটি প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদকের খাতায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। এরই সঙ্গে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন সংযোজন শুরু করেছে। এর মধ্যে আছে ওয়ালটন, সিম্ফনি, স্যামসাং, আইটেল ও ফাইভ স্টার। শিগগিরই সংযোজন শুরু করবে উই। এর বাইরে কয়েকটি চীনা ও একটি তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠান দেশের বাজারে মোবাইল ফোন সংযোজন করার কথা ভাবছে। ফলে বিশ্ববাজারে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠছে। ২০১৮ সাল তাই ছিল ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ মোবাইল ফোনের বছর।

 সতেরোতে শুরু

২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর গাজীপুরের চন্দ্রায় দেশের প্রথম স্মার্টফোন কারখানা উদ্বোধন করে ওয়ালটন। এর মধ্যে ফোর–জি সুবিধাসহ বেশ কয়েকটি মডেলের মেইড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত স্মার্টফোন বাজারে ছেড়েছে ওয়ালটন। প্রিমো জিএফ ৭, প্রিমো ই৮আই, প্রিমো এক্সফাইভসহ বেশ কয়েকটি মডেলের ফোন বাজারে ছেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়ালটন মোবাইল ফোন কারখানার আয়তন ১০ লাখ বর্গফুট। এখানে কাজ করছেন আড়াই হাজার প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান। এখানে রয়েছে গবেষণা ও উন্নয়ন, প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং, উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ প্রক্রিয়া ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও উপকরণ নিয়ন্ত্রণ, টেস্টিং ল্যাব অপারেশনস ইত্যাদি বিভাগ। ওয়ালটন মোবাইল ফোন উৎপাদন কারখানায় যেসব যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে সেগুলো হলো, হাউজিং অ্যান্ড কেসিং, চার্জার অ্যান্ড কেব্‌ল, ব্যাটারি, পিসিবি অ্যান্ড মাদারবোর্ড, ডিসপ্লে। বর্তমানে ওয়ালটন কারখানায় পিসিবি, এসএমটি, ব্যাটারি, চার্জার ইত্যাদির পাশাপাশি ছয়টি প্রডাকশন লাইন চালু রয়েছে। দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ফিচার ফোন এবং ছয় হাজার স্মার্টফোন।

ওয়ালটন সেল্যুলার ফোন বিক্রয় বিভাগের প্রধান আসিফুর রহমান খান বলেন, ওয়ালটন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে এখন আমরা পুরোপুরি স্থানীয় উৎপাদনে আছি। আমাদের নিজস্ব কারখানায় হাই-কনফিগারেশনের মোবাইল ফোন উৎপাদন বেড়েছে। গত বছর ৫১২ মেগাবাইট র‌্যামের ফোন দিয়ে উৎপাদন শুরু করি। শিগগিরই বাজারে আসছে দেশে তৈরি ৬ জিবি র‌্যামের ফোন। আশা করি আগামী বছরও ক্রেতাদের হাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উচ্চমানের ফোন তুলে দিতে পারব। মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত ‘ওলভিও এমএম ১৭’ ও ‘ওলভিও এলসিক্স’ মডেলের ফিচার ফোন দেশের বাজারে এনেছে ওয়ালটন।

 আরও আরও কারখানা

গত বছরের এপ্রিল মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে স্যামসাংয়ের ফোর–জি স্মার্টফোন তৈরির ঘোষণা দেয় স্যামসাং পণ্যের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। তারা জানায়, প্রথমেই পাওয়া যাবে ফোর–জির জন্য বেসিক মডেলের স্মার্টফোন। অন্য মডেলগুলো পর্যায়ক্রমে তৈরি হবে। জানা গেছে, শুরুতে জে সিরিজের স্মার্টফোন সংযোজনে কাজ করছে স্যামসাং। নরসিংদীর একটি কারখানায় তৈরি হচ্ছে নতুন ফোন। ওই সময় স্যামসাং ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্যাংওয়ান ইউন বলেন, ‘দেশে মোবাইল ফোন তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মোবাইল উৎপাদন কারখানা ঘোষণা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। আমরা নিশ্চিত যে স্যামসাংয়ের ফোর–জি স্মার্টফোনগুলো বাংলাদেশের ডিজিটাইজেশনের লক্ষ্য অর্জনের পথে সাহায্য করবে।’

গত আগস্ট মাস থেকে দেশে আইটেল ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন সংযোজন শুরু করেছে ট্রান্সশান বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন বিভাগের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, মেইড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত ফোনের চাহিদা এখন বাংলাদেশে বাড়ছে। ২০১৯ সালেও দামে সাশ্রয়ী ও উন্নত মানের কারণে দেশে তৈরি ফোনের চাহিদা থাকবে। বর্তমানে আইটেল এ১৬, এ১৬+ এস১৩ প্রো সংযোজন হচ্ছে দেশেই। দেশে তৈরি ফোনের কারণে গ্রাহকেরা কম দামে ফোন পাবেন। আইটেলের স্মার্টফোনের পাশাপাশি টেকনো ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন দেশে সংযোজনের পরিকল্পনাও রয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে দেশে সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন কারখানা উদ্বোধন করে এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কারখানাটিতে প্রডাকশন লাইনের পাশাপাশি গবেষণা ও উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ ও টেস্টিং ল্যাব রয়েছে। প্রাথমিকভাবে বছরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ হ্যান্ডসেট এখানে সংযোজনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সিম্ফনির। স্মার্টফোনের পাশাপাশি ফিচার ফোনও সংযোজন করা হবে এ কারখানা থেকে। রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার জিরাবোতে প্রায় ৫৭ হাজার বর্গফুট এলাকায় স্থাপিত কারখানাটি উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এডিসন গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুর রশীদ বলেন, স্মার্টফোন কারখানার মাধ্যমে সরকার ও জনগণ লাভবান হবে। এতে যেমন অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি এ খাতের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা যাবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে স্মার্টফোন আমদানি কমার পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে। সিম্ফনি জানিয়েছে, তাদের কারখানায় সংযোজন হয়ে দেশের বাজারে ই–৯০ মডেলের ফোন বাজারে এসেছে। আরও নতুন কয়েকটি ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন এখানে তৈরি হচ্ছে। আগামী বছর নতুন পণ্য দেখা যাবে।

গত বছর গাজীপুরে ফাইভ স্টার মোবাইল নামের নতুন একটি মোবাইল কারখানা উদ্বোধন করা হয়। জেলার ছয়দানায় প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে এই কারখানা স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এই কারখানায় দুই শতাধিক লোক কাজ করছেন। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে গাজীপুরের কারখানায় সংযোজিত মোবাইল ফোন ‘ফাইভ স্টার’ বাজারে ছেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কারখানায় বর্তমানে চারটি মডেলের মোবাইল ফোন প্রস্তুত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে পি ৮, জিআর৩, ওয়াই ৩ ও জিআর৭।

 আগামী মাসে নতুন কারখানা

এদিকে দেশে মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপনের কাজ গুছিয়ে এনেছে স্থানীয় ব্র্যান্ড উইয়ের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আমরা টেকনোলজিস। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শুরু করবে। শুরুতে বছরে দেড় লাখ ইউনিট হ্যান্ডসেট উৎপাদন লক্ষ্য ঠিক করেছে তারা। দেশে ফোন উৎপাদনের পাশাপাশি তিনটি দেশে রপ্তানির পরিকল্পনাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে দেশের বাজার বুঝে বাংলাদেশে ফোন সংযোজনের পরিকল্পনার কথা জানান শাওমির ভারতীয় কার্যক্রমের প্রধান মানু কুমার জেইন। এর বাইরে দেশে এরিকসনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মোবাইল সংযোজন করার আগ্রহের কথা জানা যায়।