অ্যাপলের লোকসানে লাভ কার?

নতুন মডেলের আইফোন বিক্রি কমে গেছে। ছবি: রয়টার্স
নতুন মডেলের আইফোন বিক্রি কমে গেছে। ছবি: রয়টার্স

কথায় বলে, কারও পৌষ মাস তো কারও সর্বনাশ। প্রযুক্তি বিশ্বে এ কথা এখন আইফোন নির্মাতা অ্যাপলের জন্য বেশ খাটে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাপলের সর্বনাশ হলেই যে অনেক সাধারণ মানুষের লাভ। এতে প্রতিবছর নতুন নতুন আইফোনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে না। বেশি টাকা খরচ করতেও হবে না। মানুষ এখন এ বিষয়ে সচেতন। সহজে তার পুরোনো ফোন ছাড়ছে না। এতে নতুন ফোন বিক্রি কমছে।

বিশ্বজুড়েই ২০১৮ সালে অনেক মানুষ অ্যাপলের দামি আইফোনের দিকে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। তাই খুব বেশি সাড়া জাগাতে পারেনি গত বছরের শেষ প্রান্তিকে বাজারে আসা আইফোনের নতুন তিনটি মডেল। অ্যাপল কর্তৃপক্ষও বিষয়টি বুঝতে পেরে আগেভাগেই তাদের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছেঁটে ফেলে।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আইফোন বিক্রি থেকে আসা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর বিষয়টি বাজারে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এর কারণ অবশ্য সহজে অনুমান করা যায়। আইফোনের বিক্রির গতি কম হওয়া এর অন্যতম কারণ। এ খবর চাউর হতেই ঊর্ধ্বগতিতে ছুটে চলা অ্যাপলের শেয়ারের দামে লাগাম পড়ে। ৩ জানুয়ারি অ্যাপলের শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে দেখা যায়। অ্যাপলের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দামেও বড় ধাক্কা লাগে।

অবশ্য শুধু অ্যাপলকে দেখলে হবে না, বিশ্বের শীর্ষ স্মার্টফোন নির্মাতার দিকেও তাকাতে হবে। গত তিন মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন বিক্রিও কমেছে। উল্লেখ্য, অ্যাপলের আইফোনের জন্য যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী হিসেবেও কাজ করে স্যামসাং।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৭ সালে যে পরিমাণ স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছিল, ২০১৮ সালে তার চেয়ে কম বিক্রি হয়েছে। ঘটনাটি বছরভিত্তিক স্মার্টফোন খাতের হিসেবে প্রথমবার ঘটল। এ খাতে ঊর্ধ্বগতির আশায় যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের জন্য দুঃসংবাদ। তবে বড় পরিসরে চিন্তা করলে প্রতিবছর ১৪০ কোটি স্মার্টফোন বিক্রির ঘটনা মানবতার জন্য দারুণ সুসংবাদ।

মানুষ অর্থ খরচ করে কেনে—এমন পণ্যের মধ্যে ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল গ্রাহক পণ্য হিসেবে স্মার্টফোনকে ভোট দিয়েছে মানুষ। বিশ্বের ৫৫০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি মানুষের কাছে একটি ফোন আছে। এই স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সুবিধা নিয়ে কোটি কোটি মানুষ তথ্য ও সেবা পাচ্ছে। মোবাইল ফোনের কারণে বাজারে দক্ষতা বাড়ছে, উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তবে এর বিপরীতে ভুয়া তথ্য ছড়ানো ও সময় নষ্ট করার মতো যন্ত্র হিসেবেও এটি ব্যবহার হচ্ছে। তবে, মন্দের চেয়ে ভালোর দিকটাই অনেক বেশি। অস্তিত্ব উন্নয়নের কথা বললে এটি দারুণ কার্যকর একটি টুল।

স্মার্টফোন বিক্রি কমে যাওয়া মানে কি এর চমক ফুরিয়ে যাওয়া? তা কিন্তু নয়। প্রকৃত বিষয় হচ্ছে মার্কেট স্যাচুরেশন বা চাহিদা ও জোগান সমান পর্যায়ে চলে এসেছে। এক দশকজুড়ে স্মার্টফোন দ্রুত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন ফার্স্ট টাইম বায়ার বা প্রথমবার স্মার্টফোন কিনবে—এমন ক্রেতা কমে গেছে। স্মার্টফোন বিক্রেতা আনকোরা গ্রাহক পাচ্ছে খুব কম। এ বিষয়টিই অ্যাপলের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মার্টফোনের বাজারে মাত্র ১৩ শতাংশ দখল নিয়েও বাজারের বেশির ভাগ মুনাফা করে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। এটাই এখন অ্যাপলের যন্ত্রণা আর মানুষের মুক্তি। সুবিধা হচ্ছে, জাদুর এ যন্ত্র এখন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে এটা নিয়ে এখন উদ্‌যাপন করা যায়।

যাদের এখনো স্মার্টফোন নেই, তারা কি নতুন স্মার্টফোনের দিকে যাবে? বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফোনের রিপ্লেসমেন্ট বা পরিবর্তনের চক্র এখন দীর্ঘতর হচ্ছে। মানুষ এখন আর ঘন ঘন ফোন বদলাচ্ছে না। কারণ, স্মার্টফোনে নতুনত্ব বলে কিছু দেখে তা তারা।

ইকোনমিস্ট বলছে, অনেক ফোন তিন বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করছেন মানুষ। অনেকে রিফারবিশড ও পুরোনো ফোনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই স্মার্টফোনের হালনাগাদের সময়টা বেশি হলেও প্রকৃতপক্ষে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার কিন্তু বাড়ছে। এর কারণ, অনেকেই স্মার্টফোনের সুবিধা পেতে শুরু করেছেন। এখন স্মার্টফোনের হালনাগাদ যত দেরিতে হয়, ততই অনেকের জন্য স্বস্তির।

তবে কি উদ্ভাবনে গতি কমছে? না, স্মার্টফোনের উদ্ভাবনী ফিচারের ক্ষেত্রে গতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। নতুন স্মার্টফোনগুলোয় চালাকি করে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করা হচ্ছে। থ্রিডি ফেস স্ক্যানার, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত ক্যামেরা যুক্ত হচ্ছে এতে। স্মার্টফোনের এ ধরনের প্রযুক্তি যতটা প্রভাব ফেলছে, মূলধারার গাড়ি, ওয়াশিং মেশিনের মতো নতুন প্রযুক্তি ততটা প্রভাব ফেলছে না। এর অর্থ, স্মার্টফোনের বাড়তি কিছু উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। স্মার্টফোন ঘিরেই এখনকার উদ্ভাবন হিসেবে মোবাইল পেমেন্টস, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের মতো সেবা গড়ে উঠেছে। ভবিষ্যতের স্মার্টহোম ও রোবট ট্যাক্সি সেবা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কম্পিউটার এখন দিনকে দিন ছোট হচ্ছে আর মানুষের কাছাকাছি আসছে। অনেকেই বলছেন, ওয়্যারেবল ডিভাইস বা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তিপণ্য ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির হেডসেটের মতো পণ্য আগামী দিনের বড় প্রযুক্তিপণ্য হয়ে উঠবে। তবে স্মার্টফোনের মতো আরেকটি পণ্য খুঁজে পাওয়া এখনো দূরস্ত। স্মার্টফোন এখনো কম্পিউটিং ও বৈশ্বিক যোগাযোগের খাতে নিজের প্রতিশ্রুতি ও আবেদন ধরে রেখেছে। তবে এখন স্মার্টফোন বিক্রি কমে যাওয়াটা এ খাতের জন্য অবশ্যই খারাপ খবর। বৈশ্বিক পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির কথা চিন্তা করে মানুষের জন্য একে শুভ সূচনার ইঙ্গিত হিসেবেও দেখা যায়।