জহিরুলের প্রকৃতি ও প্রযুক্তি

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। ছবি: সুমন ইউসুফ
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। ছবি: সুমন ইউসুফ
>

দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তিপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। তিনি জানালেন প্রযুক্তিপণ্যের সঙ্গে তাঁর জীবনযাপনের কথা।

লক্ষ্মীপুরে স্কুল–কলেজে পড়ার সময় মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামের কাছে প্রযুক্তির বিস্ময় বলতে ছিল ডিজিটাল হাতঘড়ি। ২৫–২৬ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন তাঁর সন্তানেরা পড়াশোনা শিখছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ১৬ জানুয়ারি ঢাকার কলাবাগানে নিজের অফিসে বসে জহিরুল বলছিলেন, ‘আমার বড় মেয়ে একদিন বলল, “বাবা, আমার হোম টিউটরের হেল্প দরকার নেই। গুগলেই সব পেয়ে যাচ্ছি।” এটা শুনে আমি আমার স্কুলবেলার কথা মনে করলাম। তখন এসব আমরা চিন্তাই করতে পারিনি। প্রযুক্তি আমাদের জীবন যে এভাবে বদলে দেবে, তা কে ভেবেছিল!’

নব্বইয়ের দশকে বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসা শুরু করেন জহিরুল। কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচয় তারও আগে, চাচাতো ভাইয়ের কম্পিউটারে মাইনসুইপার গেম খেলতে খেলতে। ২০ মেগাবাইটের এক হার্ডড্রাইভ দেখেই তখন বিস্মিত হওয়ার সময়। তার মধ্যেই একদিন হাতে পেলেন ১০০ মেগাবাইটের হার্ডড্রাইভ। জহিরুল সেদিনের কথা মনে করে হাসলেন। বললেন, ‘ওই হার্ডড্রাইভটা হাতে পেয়ে কতক্ষণ যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কী বিস্ময়! কী বিস্ময়! এতটুকুন একটা যন্ত্রের মধ্যে কত কিছু লুকিয়ে আছে। সেই হার্ডড্রাইভটাই আমার প্রযুক্তিজীবনের প্রথম চমক বলতে পারেন।’

এই চমকগুলো নিয়ে জহিরুলের পথচলা শুরু। একে একে হালনাগাদ যন্ত্রগুলোর সঙ্গে পরিচয় হতে লাগল ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। ‘তবে আগ্রহও ছিল প্রচণ্ড।’ জহিরুল বলছিলেন, ‘কেবল ব্যবসার জন্যই নয়, নতুন যন্ত্রের বেলায় আমার আগ্রহ শুরু থেকেই। এখনো বাজারে নতুন কোনো যন্ত্র এলে একবার হলেও নেড়েচেড়ে দেখি।’

জহিরুলের বর্তমান সঙ্গী আইফোন, স্যামসাংয়ের ফোনও ব্যবহার করেন। অ্যাপল আর ডেলের ল্যাপটপ নিত্যসঙ্গী, বাসায় ব্যবহার করেন স্যামসাংয়ের ডেস্কটপ কম্পিউটার। আর হাতে আছে অ্যাপলের স্মার্টওয়াচ। শুরুটা হয়েছিল সনি এরিকসন দিয়ে। সেই ফোনটার কথা বলতে গিয়ে মনে হলো জহিরুল যেন প্রিয় এক বন্ধুর স্মৃতিচারণা করছেন, ‘১৯৯৮ সালের কথা। বাসায় বেশ শক্ত যুক্তি দেখিয়ে ফোন কেনার কথাটা বললাম। তখন অবশ্য আমি ব্যবসায় ঢুকে গেছি, ফলে ফোনটা আসলেই দরকার ছিল। তারপর টাকা জোগাড় করে বাংলামোটরের অফিস থেকে গেলাম ইস্টার্ন প্লাজায়। ১২ কিংবা ১৩ হাজার টাকায় কিনলাম সনি এরিকসনের ৬২৮ মডেলের ফোনটি। কভারটি নীল রঙের, অ্যান্টেনা ছিল। কিনেই সবাইকে দেখাতে শুরু করলাম। তখন হাতে ফোন থাকা মানে অন্য রকম একটা ব্যাপার। গ্রামে গেলে মানুষ তো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। তাদের প্রশ্ন ছিল, এই যন্ত্র দিয়ে মানুষ কী করে কথা বলে!’

ফোনের কথা ওঠায় জহিরুল কেন এতটা আবেগপ্রবণ হলেন, সেটাও আবিষ্কৃত হলো একসময়। প্রিয় ফোনটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন, ‘বছর তিনেক ব্যবহার করেছিলাম ওটা। পরে একদিন ব্যাগ থেকে পড়ে গেল না চুরি হয়ে গেল, তা আর বুঝতে পারলাম না। এখনো মনে পড়ে ওই ফোনটার কথা।’

প্রথম ফোনটি হারিয়ে ফেললেও ব্যবহৃত কোনো যন্ত্রই নষ্ট হয়নি জহিরুলের। পুরোনো অনেক যন্ত্রই এখন ব্যবহার না করলেও আছে বহাল তবিয়তে। জহিরুলের মতে, ‘যন্ত্রের বেলায়ও আন্তরিক যত্ন দরকার। প্রযুক্তিপণ্যের যত্নের ব্যাপারে আমি সব সময় সচেতন। তরল কিছুর সংস্পর্শে না রাখা, নিয়মিত ব্যাটারি চার্জ করা, হাত থেকে ফেলে না দেওয়া, ভাইরাস গার্ড ব্যবহার করা—এগুলো মেনে চললে প্রযুক্তিপণ্য ভালো রাখা সম্ভব।’

আর প্রযুক্তিপণ্যগুলো আপনাকে ভালো রাখছে কীভাবে? কোন কোন অ্যাপ আপনার জীবন সহজ করে দিচ্ছে? জহিরুল জানালেন, এনি ডু, ক্যালেন্ডার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, স্কাইপে—এই অ্যাপগুলো ছাড়া তাঁর চলে না। অবসরের সঙ্গী এখন নেটফ্লিক্স, ইউটিউব আর ফেসবুক। তবে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ফোন ধরে রাখায় তাঁর প্রবল অনীহা। তাই অদূর ভবিষ্যতে একটা বায়োনিক হাত পেলে তিনি খুশিই হবেন।

ভবিষ্যতের প্রযুক্তিপণ্যের ব্যাপারে জহিরুলের আশা আরও অনেক বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে প্রযুক্তি যেভাবে সেঁটে যাচ্ছে, তাতে তিনি আরও আশাবাদী। তাঁর ভাষায়, ‘ফ্রিজের সঙ্গেই এখন ই–মেইল করার ব্যবস্থা আছে। আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) এখন কৃষিকাজে বড় ভূমিকা রাখছে। ড্রোন বিশ্বের বহু দেশে বেশ প্রচলিত। চালকহীন গাড়িও এগিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে। ফলে আমরাও যেন বসে না থাকি। সময়ের সঙ্গে চলতে হলে নতুন কিছু আমাদের করতেই হবে।’

ব্যবসা প্রযুক্তি নিয়ে, ঘরে গিয়েও প্রযুক্তির সঙ্গে ওঠাবসা করছেন জহিরুল। কিন্তু তারপরও তাঁর মনটা প্রকৃতিতেই বেশি টানে। পাহাড় ভালোবাসেন জহিরুল। সময় পেলেই পাহাড়ে যান। একটা সময় নিয়মিতই যেতেন। বছর দুয়েক হলো তাতে বিরতি পড়েছে। তাই ‘কবে যাব পাহাড়ে, আহা রে আহা রে!’ করছেন তিনি।

জহিরুল বললেন, ‘কথা চলছে, সামনের মাসেই হয়তো বেরিয়ে পড়ব। প্রযুক্তি আমার ধ্যানজ্ঞান হলেও আমি এটা বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিতেই আসল শান্তি। আমি গাছ ভালোবাসি, পশুপাখি আমাকে আনন্দ দেয়। প্রযুক্তি নিজের গতিতে এগিয়ে যাবে, সেসবের সুবিধা নিয়েই আমি প্রকৃতিকে আরও গভীরভাবে ভালোবাসতে চাই।’