ইঞ্জিনের যত্ন নিন

ইঞ্জিন ভালো থাকলে গাড়ি চলে ঝামেলাহীন। তাই নিয়মিত গাড়ির ইঞ্জিনের যত্ন নিতে হবে
ইঞ্জিন ভালো থাকলে গাড়ি চলে ঝামেলাহীন। তাই নিয়মিত গাড়ির ইঞ্জিনের যত্ন নিতে হবে

‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন’ প্রবাদটি শুধু মানুষের জন্য নয়, গাড়ির জন্যও প্রযোজ্য। একটি গাড়ির প্রধান অংশ হলো ইঞ্জিন। যদি ইঞ্জিন ভালো থাকে, সে গাড়ি থেকে আরামদায়ক এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় চলাচল আশা করা যায়। ‘যতনে রতন মেলে’, তেমনি একটি গাড়ির সহজ কিছু বিষয় নিয়মিত পর্যবেক্ষণে ইঞ্জিনের স্থায়িত্ব এবং মাইলেজ বেড়ে যায়। গাড়ির ইঞ্জিনের যত্ন নিয়ে জ্বালানি খরচ কমাতে আপনিও নিতে পারেন সহজ পদক্ষেপগুলো। একনজরে গাড়ির যত্ন নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।

ঠিক সময়ে ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন

গাড়ি চালানোর জন্য জ্বালানি খরচ করতে হয়। ফুয়েল বা গ্যাস ছাড়া আরও কিছু তেল গাড়ির জন্য জরুরি। ইঞ্জিন অয়েল এর একটি। ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর এর যন্ত্রাংশগুলো ঘুরতে থাকে। এই যন্ত্রাংশগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে। সংযুক্ত যন্ত্রাংশগুলোর ঘূর্ণনে তাপ উৎপাদন হয়। এতে ইঞ্জিন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ক্ষয় থেকে রক্ষা করার জন্য একধরনের পিচ্ছিল তেল ব্যবহৃত হয়। তরল এই পদার্থ ঘূর্ণনের ফলে উৎপন্ন তাপ থেকে ইঞ্জিনকে রক্ষা করে। ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতাকে কার্যকর রেখে তাপ প্রশমনের জন্য যে অয়েল ব্যবহৃত হয়, তাকেই ইঞ্জিন অয়েল বলে।

বাজারে তিন ধরনের ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায়। ভূগর্ভ থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তাকে মিনারেল অয়েল বলে। এই ধরনের ইঞ্জিন অয়েল দ্রুত পরিবর্তন করতে হয়। তিন হাজার কিলোমিটার পর এই ধরনের ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করা উত্তম। গবেষণাগারে যে তেল উৎপন্ন করা হয়, তাকে সিনথেটিক অয়েল বলে। সিনথেটিক অয়েলের কার্যক্ষমতা বেশি। পাঁচ থেকে সাত হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত এই ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা যায়। আর মিনারেল এবং সিনথেটিকের মিশ্রণে যে ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায়, তাকে সেমি সিনথেটিক ইঞ্জিন অয়েল বলে। তিন থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত এই তেল ব্যবহার করা যায়।

এ ছাড়া রয়েছে ইঞ্জিন অয়েলের গ্রেড। ‘ডব্লিউ’ চিহ্ন দিয়ে আবহাওয়ার সংকেত বোঝানো হয়। ৫ ডব্লিউ ৩০–এর মানে হলো ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার ওপরে এবং ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত আবহাওয়ার জন্য উপযোগী ইঞ্জিন অয়েল। গাড়ির নির্দেশিকায় (ম্যানুয়েল) কোন গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করতে হবে তার উল্লেখ থাকে। সে অনুযায়ী ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা ভালো। গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল কী পরিমাণ আছে, দেখার জন্য একটি স্কেল রয়েছে। এই স্কেলে দাগ কেটে পরিমাপক নির্দেশ করা থাকে। দাগের নিচে ইঞ্জিন অয়েল থাকলে ইঞ্জিন অয়েল ঢেলে লেভেল ঠিক রাখা দরকার।

ইঞ্জিন অয়েল ফিল্টার পরিবর্তন করা

ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর ইঞ্জিন অয়েল গাড়ির ইঞ্জিনে ঘুরতে থাকে। ইঞ্জিন থেমে গেলে অয়েল চেম্বারে ইঞ্জিন অয়েল ফিরে আসে। তাই গাড়ি চালু করার পর ইঞ্জিনে অয়েল পৌঁছানোর জন্য সময় দিতে হয়। দিনের প্রথমে ইঞ্জিন চালু করে কয়েক মিনিট রেখে দেওয়া উত্তম। এতে ইঞ্জিন অয়েল পুরো ইঞ্জিনে ছড়িয়ে পড়ে। ইঞ্জিন অয়েলে যে ময়লা জমা হয়, তা ইঞ্জিন অয়েল ফিল্টার শুষে নেয়। ময়লা জমতে জমতে একসময় ইঞ্জিন অয়েল ফিল্টারটি অকেজো হয়ে যায়। তাই ইঞ্জিন অয়েল বদলানোর সময় ইঞ্জিন অয়েল ফিল্টারটিও বদলানো প্রয়োজন।

নিয়মিত এয়ার ফিল্টার পরিষ্কার করা

ধুলোবালি থেকে নিশ্বাসকে সতেজ রাখতে মানুষের নাকের ভেতরে ছাঁকনি থাকে। তেমনি গাড়ির ভেতরে ইঞ্জিনে বাতাস আসা–যাওয়ার জন্য একধরনের ছাঁকনি রয়েছে। গাড়ির এই যন্ত্রাংশের নাম এয়ার ফিল্টার। বাইরের ধুলাবালিযুক্ত বাতাসকে পরিষ্কার করে এই যন্ত্র ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখে। ধুলাবালি জমে এয়ার ফিল্টারের কার্যক্ষমতাও হ্রাস পায়। এক সপ্তাহ পরপর এয়ার ফিল্টার খুলে হাওয়া মেশিন দিয়ে এয়ার ফিল্টার পরিষ্কার করা প্রয়োজন। প্রতি ১০ হাজার কিলোমিটার পর এয়ার ফিল্টার পাল্টাতে গাড়ি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো পরামর্শ দিয়ে থাকে।

ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেমের প্রতি যত্নবান হওয়া

ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখার জন্য একধরনের কুল্যান্ট ওয়াটার পাওয়া যায়। এই কুল্যান্ট ওয়াটারও ইঞ্জিনে উৎপাদিত তাপকে কমিয়ে দেয়। গাড়ির ইঞ্জিনের রেডিয়টরে কুল্যান্ট ওয়াটার দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে রেডিয়েটর চেক করা উচিত। পানি কমে গেলে কুল্যান্ট ওয়াটার দিয়ে পরিপূর্ণ করতে হবে। ইঞ্জিন ঠান্ডা থাকা অবস্থায় কুল্যান্ট ওয়াটার চেক বা পরিবর্তন করতে হয়। কুল্যান্ট ওয়াটারের বদলে অনেকে মিনারেল ওয়াটারও ব্যবহার করে থাকেন।

এসি ফিল্টার পরিষ্কার রাখা

গাড়ির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রেও ফিল্টার থাকে। এই ফিল্টারে ধুলাবালি জমলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। তখন গাড়ি অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা হয়। এয়ার ফিল্টারের পাশাপাশি এসি ফিল্টারও পরিষ্কার রাখা বাঞ্ছনীয়। সাধারণত গাড়ির চালকের পাশের আসনে ড্যাশবোর্ডের নিচের স্টোরেজের পরে এসি ফিল্টার থাকে। বেশি ধুলাবালি জমে গেলে এসি ফিল্টারও পরিবর্তন করতে হয়।

সময়মতো ব্রেক ফ্লুইড পরিবর্তন করা

গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্রেক গুরুত্বপূর্ণ। ব্রেকেও একধরনের ফ্লুইড ব্যবহৃত হয়। এই ফ্লুইড কমে গেলে ব্রেকের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। ব্রেকের ব্যবহার বেশি হলে ব্রেকের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তখন গাড়ির ব্রেক অ্যাডজাস্ট করতে হয়। এতেও কাজ না হলে ব্রেক ফ্লুইড পরিবর্তন করতে হয়।

গিয়ার অয়েল পরিবর্তন করা

দেশের অধিকাংশ গাড়ি স্বয়ংক্রিয় গিয়ারে পরিচালিত হয়। এই গিয়ার সিস্টেমে শুধু ‘ডি’ দ্বারা ড্রাইভ করা গেলেও ইঞ্জিন তার প্রয়োজনমতো গিয়ার শিফট করে থাকে। যথাযথ গিয়ার শিফটিংয়ের জন্য গিয়ার বক্সে একধরনের তরল পদার্থ ব্যবহৃত হয়। একে গিয়ার ফ্লুইড বলে। গিয়ার শিফটিংয়ে যদি গাড়িতে ত্রুটি দেখা দেয় অথবা গিয়ার দেওয়ার পরে যদি দেরিতে গাড়ির ইঞ্জিন কাজ করে, তাহলে গিয়ার ফ্লুইড বদলাতে হয়।

স্পিডোমিটারের সতর্কসংকেত

গাড়িতে ব্যাটারি বা ইঞ্জিন অয়েল ঠিকমতো কাজ না করলে একধরনের সাইন প্রদর্শিত হয়। যদি হঠাৎ এসে আবার সে সাইন চলে যায়, তাহলে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সব সময় সেই সাইন থাকলে দেরি না করে বিষয়গুলো চেক করা উচিত। তাহলে অল্পতেই সমস্যার সমাধান হবে।

স্পার্ক প্লাগ পরিষ্কার বা পরিবর্তন করা

স্পার্ক প্লাগ স্ফুলিঙ্গ উৎপাদন করে ফুয়েল পুড়িয়ে ইঞ্জিনকে চলতে সহায়তা করে। স্পার্ক প্লাগ পরিষ্কার থাকলে কাজটি সহজ হয়। পুরোনো স্পার্গ প্লাগ ঠিক সময়ে স্ফুলিঙ্গ উৎপাদন করতে পারে না। তাই স্পার্গ প্লাগ পুরোনো হলে তা বদলে ফেলতে হবে।

ইঞ্জিনের এই বিষয়গুলোর প্রতি যত্নশীল হলে ইঞ্জিন দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভালো সেবা দিতে পারে। ইঞ্জিনের অবস্থা টিপটপ থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি খরচ কমে আসে। হাইব্রিড গাড়িতে ইঞ্জিনের পাশাপাশি ইলেকট্রিক মটর ব্যবহৃত হয়। হুটহাট গতি না বাড়িয়ে প্রয়োজনমতো এক্সিলারেশন প্রেস করে গাড়ি চালালে ইঞ্জিন ফুয়েল সাশ্রয়ী হয়। হাইব্রিড গাড়ি যখন থেমে থাকে, তখন গিয়ার পজিশন নিউট্রাল (এন) এ না রেখে পার্কিংয়ে (পি) রাখা উত্তম। এতে ব্যাটারি চাকা থেকে চার্জ সংগ্রহ করে এবং বেশি মাইলেজ দেয়।