জবস, বিল ও মার্কের ভালোবাসা

অ্যাপলের স্টিভ জবস, মাইক্রোসফটের বিল গেটস ও ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ—পৃথিবী বদলে দিয়েছেন এই তিনজন। তাঁদের সৃষ্টিতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বিশ্বের বহু মানুষকে যাঁরা মুগ্ধ করেছেন, তাঁরাও মুগ্ধ হয়েছেন কারও কারও চোখের দিকে তাকিয়ে। তাঁদের জীবনে ভালোবাসা এসেছে, ঘর বেঁধেছেন আবার বিচ্ছেদও ছিল। উঁকি মারা যাক এই তিন টেকগুরুর প্রণয়জীবনে। লিখেছেন মাহফুজ রহমান


জবসের দুই অধ্যায়

স্টিভ জবস ও লরেন পাওয়েল
স্টিভ জবস ও লরেন পাওয়েল

স্টিভ জবসের প্রণয়জীবনে আছে দুটি অধ্যায়। প্রথমটির ব্যাপ্তি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। এই অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্রিস্যান ব্রেনানের নাম। দ্বিতীয়টি লরেন পাওয়েলের সঙ্গে, ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল অর্থাৎ জবসের মৃত্যু পর্যন্ত।

জবসের প্রেমের প্রথম অধ্যায়টি বেশ নাটকীয়। ১৯৭২ সালে ব্রেনানের প্রেমে পড়েছিলেন। দুজনই তখন হাইস্কুল-পড়ুয়া। জবস কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও সম্পর্কটা অটুট ছিল। কিন্তু ব্রেনান ঠিক করলেন, কলেজে ভর্তি হবেন না। সম্পর্কে ভাটার টান সেই থেকে শুরু। জবস অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও ব্রেনানের মন গলাতে না পেরে নতুন সঙ্গী খুঁজতে শুরু করলেন। ব্রেনানও নতুন সঙ্গীর দেখা পেয়েছেন ছবি আঁকার ক্লাসে।

নতুন সঙ্গী খুঁজে পেলেও জবস-ব্রেনানের মধ্যে অদ্ভুত এক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকল। মরিচবাতির মতো এই জ্বলে এই নেভে। ব্রেনান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘না পারছিলাম ছাড়তে, না পারছিলাম কথা দিতে।’ ফলে ধীরে ধীরে সম্পর্কটা ফিকে হয়ে এল। আবার ১৯৭৪ সালে সম্পর্কের গোড়ায় পানি দিয়ে সজীব করে তুললেন জবস ও ব্রেনান। জবস তত দিনে ভারতভ্রমণ করে এসেছেন। মনোজগতে বিশাল এক পরিবর্তন এসেছে। হঠাৎ কী হলো, ব্রেনানও ঠিক করলেন নতুন এক সঙ্গীকে নিয়ে ভারত ভ্রমণে বের হবেন। মনে মনে কষ্ট পেলেও ভারতভ্রমণে যথাসাধ্য সহযোগিতা করলেন জবস। ব্রেনান ভারত ঘুরে এলে সম্পর্কটা আবার চাঙা হলো!

ব্রেনানের কোলে তাঁর মেয়ে লিসা ব্রেনান–জবস
ব্রেনানের কোলে তাঁর মেয়ে লিসা ব্রেনান–জবস

১৯৭৫ সালে আরেকটি বিরতি! শেষমেশ ১৯৭৭ সালে জবস যখন অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করলেন তখন সম্পর্কের পালে হাওয়া লাগল নতুন করে। কুপারটিনোতে ব্রেনানের সঙ্গে বাসা নিলেন জবস। হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন, ব্রেনান মা হতে চলেছেন। বদলে গেল জবসের মেজাজমর্জি! ব্রেনান কুপারটিনোর বাসা ছাড়লেন। সম্পর্কে ফুলস্টপ পড়ে গেল সেখানেই। ১৯৭৮ সালে জন্ম নিল লিসা ব্রেনান-জবস। কিন্তু সন্তানের বাবা হিসেবে কোনো দায়িত্ব নিলেন না জবস। এমনকি সন্তানের বাবার পরিচয়ও অস্বীকার করলেন অবলীলায়। ডিএনএ পরীক্ষায় সব প্রমাণ হওয়ার পরও নিজের যুক্তি থেকে নড়লেন না। শেষমেশ লিসাকে সন্তানের স্বীকৃতি অবশ্য তিনি দিয়েছেন, তত দিনে বেলা অনেকটা গড়িয়েছে।

লরেনের সঙ্গে আমৃত্যু
জবসের প্রণয়জীবনে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু ১৯৮৯ সালে। কোনো এক বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলে গিয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। লরেন পাওয়েল তখন সদ্য স্নাতক। বক্তৃতা শুনতে যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই আসন না পেয়ে বসে পড়েছিলেন মঞ্চের একেবারে সামনে। একসময় সেখান থেকে উঠে যেতে বলায় সংরক্ষিত একটি আসনেই বসে পড়েন লরেন। ঠিক পাশের আসনেই এসে বসেন জবস। পাশের আসন তো নয়, সেদিন যেন জবসের মনের আসনেই বসে পড়েছিলেন লরেন। প্রথম দেখাতেই লরেনে মুগ্ধ জবস সে রাতে একটা মিটিং বাতিল করে দিলেন পর্যন্ত! কাজপাগল এই মানুষটি রাতে ডিনারের আমন্ত্রণও জানালেন। ‘না’ বলার ক্ষমতা ছিল না লরেনের। শেষমেশ ১৯৯১ সালে পাকাপাকিভাবে ‘হ্যাঁ’-ও বলে দিলেন। সে সম্পর্ক গড়াল জবসের মৃত্যু পর্যন্ত।

বিল-মেলিন্ডার ভালোবাসার ফাউন্ডেশন

বিল গেটসের অনেক খবরই আমরা রাখি। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি যে চুরি হয়েছিল, সে খবর কি জানা আছে? এর জন্য অবশ্য বিলের দায় আছে ৫০ শতাংশ। বাকি ৫০ মেলিন্ডা অ্যান ফ্রেঞ্চ নামের এক তরুণীর। বিলের মনটা যে তিনিই চুরি করেছিলেন। নিজের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি অবশ্য খুশিমনেই চুরি করতে দিয়েছিলেন বিল। আর এই ভদ্রলোকের মনে পাকাপাকিভাবে আসন নেওয়ার পরই মেলিন্ডা অ্যান ফ্রেঞ্চ হলেন মেলিন্ডা গেটস।

১৯৮৬ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়ে বের হয়েছেন মেলিন্ডা। শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছেন আইবিএমে। হঠাৎ একদিন ডাক পেলেন মাইক্রোসফট করপোরেশন থেকে। বিল গেটস ও পল অ্যালেনের এই প্রতিষ্ঠানটির ভিত তখনো অত মজবুত নয়। কিন্তু মেলিন্ডা মেধাবী তরুণী, দূরদর্শী। চোখ বুজে যোগ দিলেন সেখানে।

বিল ও মেলিন্ডা গেটস
বিল ও মেলিন্ডা গেটস

মেলিন্ডা এলেন মাইক্রোসফটে

হতাশ হতে হলো না মেলিন্ডাকে। সাড়ে ছয় বছর পর পদোন্নতি হলো তাঁর। সফটওয়্যার বিপণন বিভাগের নবিশ থেকে হয়ে উঠলেন ইনফরমেশন প্রোডাক্টস মহাব্যবস্থাপক। নিজের যোগ্যতায় এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত মেলিন্ডা বিল গেটসের আরও কাছে চলে গেলেন। মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহীর মনে ধীরে ধীরে একটা ‘সফট কর্নার’ তৈরি হতে শুরু করল তখন থেকেই। বুঝতেই পারছেন কার জন্য!

লেগে থাকলেন বিল গেটস

বিল গেটস তখনই হার্ভার্ডের সফল ড্রপআউট হিসেবে খ্যাত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শেষ করতে না পারার খুঁতখুঁতানি তাঁর ছিলই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে বেরিয়ে আসা ঝকঝকে মেধাবী মেলিন্ডার ব্যাপারে সব সময় মুগ্ধ ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালেই মূলত প্রথম পরিচয় তাঁদের। মাইক্রোসফটে চাকরির চার মাস হয়ে গেছে মেলিন্ডার। নিউইয়র্কে এক্সপো ট্রেড ফেয়ারের এক ডিনারে গিয়েই কথাবার্তার শুরু। এক সাক্ষাৎকারে মেলিন্ডা সে রাতের কথা বলেছিলেন, ‘যতটা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি মজার মনে হয়েছিল বিলকে।’ এর এক মাস পর আবার আরেক বৈঠক। মেলিন্ডার কাছে বিল জানতে চাইলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক পর তুমি কি ফ্রি আছ?’ জবাবে মেলিন্ডা বলেছিলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক পরই তা জেনে নিয়ো।’

শুরুতে মেলিন্ডার দিক থেকে এমন শীতল আচরণেও দমে যাননি বিল। লেগে থাকার যে একটা ব্যাপার আছে তাঁর মধ্যে, এখানেও সেটার পরিচয় মেলে! মাস কয়েকের মধ্যে অবশ্য ধৈর্যের পুরস্কার পেলেন বিল। ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন হলো বিল ও মেলিন্ডার মনের ফাউন্ডেশনের। ১৯৯৩ সালে হলো বাগদান আর ১৯৯৪ সালের পয়লা দিনেই হয়ে গেলেন বিবাহিত।

বিয়ের এক বছরের মাথায় বিল গেটস উঠে গেলেন বিশ্বের ধনীদের শীর্ষে। মেলিন্ডাও মাইক্রোসফট এবং নানা কাজের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তারপরও তাঁদের সংসারজীবনে এখনো বসন্ত। তাঁরা কেবল অর্থবিত্তেই বড়লোক নন, মনটাও বিশাল। বিশ্বের সামনে অনুকরণীয় এক জুটি হিসেবে নিজেদের তাঁরা দাঁড় করিয়েছেন নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে। এই দম্পতির ঘরে আছে দুই মেয়ে, এক ছেলে।

প্রিসিলা চ্যান ও মার্ক জাকারবার্গ
প্রিসিলা চ্যান ও মার্ক জাকারবার্গ


জাকারবার্গ-চ্যানের সুখের সংসার

মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুকের বদৌলতে কত মানুষ যে জীবনসঙ্গী খুঁজে পেল, তার হিসাব কে রাখে! কিন্তু খোদ জাকারবার্গ তাঁর মনের মানুষের খোঁজ পেয়েছিলেন কোথায়, জানেন? বাথরুমের সামনে অপেক্ষমাণদের সারিতে! ২০০৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে এক পার্টি চলছিল। পার্টিটা দিয়েছিলেন জাকারবার্গ ও তাঁর বন্ধুরা। প্রিসিলা চ্যান তখন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। চ্যানের ভাষায়, ‘ওর হাতে ছিল একটা বিয়ারের গ্লাস। প্রোগামিংয়ের ভাষায় বন্ধুদের সঙ্গে বেশ কৌতুক করে যাচ্ছিল।’ প্রথম দেখায় ভালো লাগা, তারপর একসঙ্গে খেতে যাওয়া…। ফলে সে বছরই জাকারবার্গের সম্পর্কের স্ট্যাটাস ‘সিঙ্গল’ থেকে হয়ে গেল ‘ইন আ রিলেশনশিপ’। তবে তা বেশ গোপনই থেকে গেল।

ফেসবুকে কর্মী হিসেবে আগমন চ্যানের

২০০৪ সালে প্রথম কর্মী হিসেবে ফেসবুক যোগ দিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষার্থী চ্যান। ২০০৬ সালে ফেসবুকে জাকারবার্গের এক পোস্টে চ্যানের মন্তব্যে বোঝা গেল, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন তাঁরা। জাকারবার্গের হুডিপ্রীতি ছিল। টি-শার্টের মতো একই ধরনের হুডি দিনের পর দিন পরার বাতিক ছিল তাঁর। একটা হুডির পর্ব শেষ হলে আসত আরেকটা। এই হুডিপর্ব আবার মুখস্থ ছিল চ্যানের। সেটারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ছবির কমেন্টে।

২০০৭ সালে হার্ভার্ড থেকে স্নাতক শেষ করেন চ্যান। নতুন একটা বাসা নেন গোল্ডেন গেট পার্কে। ফেসবুক নিয়ে মার্কের ব্যস্ততা তখন তুমুল। তাই সম্পর্কের ব্যাপারে কঠিন কিছু শর্ত জুড়ে দিলেন চ্যান, ফেসবুক অফিসে নয়, প্রতি সপ্তাহে একান্তে অন্তত ১০০ মিনিট সময় দিতে হবে। অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে ফুল মার্কসই পেয়েছিলেন জাকারবার্গ! এরপর একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরো বিশ্ব। চীনে হবু শ্বশুরবাড়ি থেকেও ঘুরে আসেন এক ফাঁকে। মান্দারিন ভাষাও শিখতে শুরু করেন জোরেশোরে। ২০১০ সালে সেপ্টেম্বরে জাকারবার্গের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন চ্যান। একই মাসে ফেসবুকেও রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে পরিবর্তন আনেন জাকারবার্গ—ইন আ রিলেশনশিপ! আর ২০১২ সালে ‘ম্যারিড’! এখন এক কন্যাকে নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার।