সৌরবিদ্যুতে আলোকিত সেন্ট মার্টিন

সৌর বিদ্যুতের কারণে এখন সবসময় বিদ্যুৎ থাকে সেন্ট মার্টিনে।  দুই পর্যটক সেলফি তুলছেন। ছবি: স্মার্ট সময়
সৌর বিদ্যুতের কারণে এখন সবসময় বিদ্যুৎ থাকে সেন্ট মার্টিনে। দুই পর্যটক সেলফি তুলছেন। ছবি: স্মার্ট সময়

কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলার দমদমিয়া থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। এ দ্বীপের লোকসংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার হলেও পর্যটন মৌসুমে দ্বীপে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের ধরলে সর্বমোট প্রায় ১৫ হাজার। দ্বীপটি বাংলাদেশের মানচিত্রে সর্বদক্ষিণের টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত।

টেকনাফের দমদমিয়া জাহাজঘাট থেকে এখন প্রতিদিন পর্যটকেরা সাতটি জাহাজ ও অর্ধশতাধিক পর্যটক ট্রলারে যাতায়াত করেন সেন্ট মার্টিনে। নদী ও সাগর পেরিয়ে সাগরের মধ্যখানে সেন্ট মার্টিনের জেটিতে গিয়ে জাহাজগুলো ভিড়তে থাকে। জাহাজ থেকে নামতেই চোখে পড়ে সারি সারি বৈদ্যুতিক খুঁটির ওপর চারটি করে তার টানানো।

সেন্ট মার্টিন জেটির দুপাশে রকমারি দোকানপাট। এসব দোকানে দিনের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি। চলছে বৈদ্যুতিক পাখাও। হঠাৎ করেই নজরে আসে এসব। চা ও পান বিক্রেতা নুরুল আলম বললেন, সৌরবিদ্যুতের আলোতে এখন আলোকিত প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। দ্বীপের মানুষ ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে। ফ্রিজে রাখা যাচ্ছে পিপাসা মেটানোর রকমারি কোমল পানীয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম এখানে বেড়াতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা এই সুবিধা ভোগ করছেন।

বদি আলম নামে আরেক দোকানদার বলেন, কিছুদিন আগেও এখানে সন্ধ্যার পর চারদিকে জেনারেটরের শব্দ ও ধোঁয়ায় পরিবেশদূষণ হতো, এখন আর সেটা হয় না। আগে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানে বাতি জ্বালাতে খরচ হতো ১২০ টাকা। এখন ২৪ ঘণ্টায় খরচ হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। আগে রাত ১১টার পর পুরো দ্বীপটি ভুতুড়ে দ্বীপে পরিণত হলেও এখন সারা রাত বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত হচ্ছে। তবে বিদ্যুতের প্রতিটি ইউনিটের বাণিজ্যিক দাম রাখা হচ্ছে ৪২ টাকা।

সেন্ট মার্টিন বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে কোস্টগার্ড সড়কের পাশের পূর্বপাড়ায় ঢুকতেই রাত ১১টার দিকে দূর থেকে ভেসে আসে মিনমিন শব্দ। সামনে গেলে ফজল করিমের বাড়ি। ওই বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে লেখাপাড়া করছে ভাইবোন সেকাব উদ্দিন ও কোহিনুর আক্তার। সেকাব অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আর কোহিনুর ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তারা বলল, কিছুদিন আগেও তারা কেরোসিনের কুপিবাতি ও জেনারেটরের বাতি জ্বালিয়ে লেখাপড়া করত টিমটিমে আলোতে। এখন সৌরবিদ্যুতের আলোতে গভীর রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করছে।

সি ফাইন্ড নামে একটি হোটেলের স্বত্বাধিকারী আবদুর রহিম বলেন, ‘১০-১২ বছর ধরে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছি। আগে কখনো ভাবিনি, হোটেলে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধায় ব্যবসা করতে পারব।’ ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের আগে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় পুরো দ্বীপে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের সুবিধা পেয়েছিলেন এখানকার বাসিন্দারা। তা–ও মাত্র সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। এখন ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে সৌরবিদ্যুতের মিনি গ্রিড প্রকল্পের মাধ্যমে।

সেন্ট মার্টিনে সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল
সেন্ট মার্টিনে সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল

মিনি গ্রিড প্রকল্প

সেন্ট মার্টিন হাসপাতাল, ইউনিয়ন পরিষদ ও আবহাওয়া কার্যালয়সংলগ্ন এলাকার ৪ দশমিক ৫ বিঘা জমিতে এ সৌরবিদ্যুতের প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে। এর ক্ষমতা ২ লাখ ৫০ হাজার ওয়াট। ৪৬৫টি বৈদ্যুতিক খুঁটি দিয়ে দ্বীপে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এ প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

এ সৌর প্রকল্পের উদ্যোক্তা হলেন-ব্লু মেরিন রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) অর্থায়নে এক্সিলন বাংলাদেশ লিমিটেড ও এসকিউব টেকনোলজিস লিমিটেড ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে।

ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী প্রকল্পটির কারিগরি নকশা করেছেন এবং তাঁরই নিবিড় তত্ত্বাবধানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে।

শাহরিয়ার জানালেন, শুরুতে মোট ৫৪৮ জন গ্রাহককে বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এ সৌরবিদ্যুতের মিনি গ্রিড প্রকল্পটির নকশা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩৬টি আবাসিক বাড়িঘর, ২২টি আবাসিক হোটেল-রিসোর্ট, ১৫৭টি দোকান ও খাবারের হোটেল,
১০টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ১৫টি ইজিবাইক চার্জিং, ৬টি সেচ পাম্প, ১টি বরফকল এবং ১টি ওয়ার্কশপ রয়েছে।

গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, খোলা জায়গায় সারি সারি করে বসানো হয়েছে ৯২৫টি সৌর প্যানেল (প্রতিটি ২৭০ওয়াট করে)। এ জন্য একটি সাবস্টেশনও তৈরি করা হয়েছে। এসব সোলার প্যানেল থেকে দৈনিক প্রায় ১০০০ ইউনিট ব্যবহার উপযোগী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘এই সৌর প্রকল্পটি দ্বীপে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্বীপের মানুষ কিছুটা হলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে। এমনকি এ দ্বীপে যে একদিন এসি চালু হবে সেটা কোনো দিন কল্পনাও করিনি, যা বর্তমানে চালু করা হয়েছে।’