শূন্য থেকে সাদেকুলের এস-টেক কম্পিউটার

সাদেকুল ইসলাম
সাদেকুল ইসলাম

টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য নেই। তাই অল্প টাকায় পুরোনো একটি কম্পিউটার কিনে তার সঙ্গে টিভি কার্ড লাগিয়ে বাসায় টেলিভিশনের অভাব পূরণ করেছিলেন সাদেকুল ইসলাম। সেটি কিনতেই মায়ের হাতের আংটি আর একটি পোষা ছাগল বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি হলো দু-এক দিন পরপরই কম্পিউটারটি নষ্ট হয়। তাঁর এক বন্ধুর ভাইয়ের কম্পিউটার সারাইয়ের দোকান থেকে এটি সারিয়ে আনেন। নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সারানো যেত না। বোঝানো হতো সমস্যাটি জটিল। এটা নিয়ে সাদেকুল খুব দুশ্চিন্তায় পড়তেন। খেয়াল করলেন, প্রতিবারই একটি সিডি ঢুকিয়ে তাঁরা কম্পিউটারটি ঠিক করে দেন। পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁরা আসলে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করতেন।

একবার সাদেকুল একটি সিডি দিয়ে নিজে নিজেই উইন্ডোজ ইনস্টল করতে গেলেন। হলো না। তখন চিন্তা ভাবলেন কম্পিউটারটা বিক্রি করবেন না। কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সমস্যার সমাধান শিখে নিজেই করবেন। তাই বিনা বেতনে একটি কম্পিউটার মেরামতের দোকানে (সার্ভিস সেন্টার) কাজ নিলেন।

পাঁচ বছর দোকানে দোকানে সার্ভিসিংয়ের কাজ করে বেড়ালেন। এখন রাজশাহী নিউমার্কেটের ‘এস-টেক কম্পিউটার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন। ইতিমধ্যে ‘আই-নেক্সট’ নামে এলইডি টিভির ব্র্যান্ডের নিবন্ধনও নিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারে ছাড়বেন। গত বছরের নভেম্বর মাসে চীনে গিয়েছিলেন বাজার দেখতে।

সাদেকুলের বাড়ি রাজশাহী নগরের বড়বোনগ্রাম ভাড়ালিপাড়া এলাকায়। বাবা আবদুর রাজ্জাক একজন মাছ ব্যবসায়ী। অনটনের সংসার। সাদেকুল এসএসসি পাস করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এএইচএসসিতে ভর্তি হয়েছেন। সপ্তাহে এক দিন ক্লাস। বাকি দিনগুলো দোকানে কাজ করতে পারতেন।   

চাকরি, তবে বেতন নেই
বিনা বেতনে নগরের অলকার মোড়ে কমডেস্ক কম্পিউটারে তাঁর হাতেখড়ি। সেখানে ফুটফরমাশ খাটতেন। প্রশিক্ষণ নিতেন। সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়াম মাকের্টের সেঞ্চুরি কম্পিউটারে টাইপিংয়ের কাজ নেন। মাসে বেতন পেতেন ৮০০ টাকা। এরপর রাজশাহী নিউমার্কেটের পাশে মইয়ুখ ভবনে নেট ভিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সার্ভিসিংয়ের কাজ নেন। এখানে তাঁর পরিচয় হয় রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষকের সঙ্গে। কম বেতনের কথা শুনে তিনি ঢাকায় তাঁর বন্ধুর প্রতিষ্ঠানে থাকা-খাওয়াসহ দেড় হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরি ঠিক করে দেন। তখন ঢাকায় যেতে ৩০০ টাকা গাড়িভাড়া লাগত। এই টাকাও তাঁর ছিল না। ভাবলেন, বাড়ির কম্পিউটারের একটি র‌্যাম বিক্রি করলে সাড়ে ৫০০ টাকা পাবেন। সেই টাকা দিয়ে ঢাকায় যাবেন। র‌্যাম খুলে নিয়ে আসার পথে তাঁর এক বন্ধু র‌্যামটা হাতে নিয়ে মজা করতে চাপ দিয়ে র‌্যামটি নষ্ট করে ফেলেন। তাঁর আর ঢাকায় যাওয়া হলো না। প্রায় ছয় মাস বসে ছিলেন।

সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে
হঠাৎ একদিন খবর পেলেন। নগরের আমচত্বর এলাকায় স্কুল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার নামের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে সুযোগ পেলেন। এ প্রতিষ্ঠানে সব নতুন লোক নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে তিনিই শুধু কম্পিউটার সম্পর্কে কিছু জানতেন। ভারত থেকে একজন প্রকৌশলী এসে তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিলেন। এই ধারণা নিয়ে কাজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে সেখানে তাঁর পদের নাম দেওয়া হয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তবে কোনো বেতন ছিল না।

কিছুদিন পরে কম্পিউটার ঠিক করতে এসে খোঁজ পেয়ে যান রাজশাহী নিউমার্কেটের ওয়ার্ড ভিশন সাইবার ক্যাফে নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। সেখানেই তাঁর কাজ জুটে যায়। একসময় সাইবার ক্যাফে আর চলছিল না। তখন তাঁকে দিয়ে শুধু সার্ভিসিং করানো হতো।

সার্ভিসিংয়ের কাজে দক্ষতার কারণে সাদেকুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অনেকের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক হয়। ফোনও মেরামত করতে শুরু করেন। বিনিময়ে টাকা নিতেন না। এ প্রতিষ্ঠানে অনেকে পুরোনো কম্পিউটার বিক্রির জন্য আসতেন। তিনি অগ্রিম বেতন নিয়ে কম্পিউটার কিনে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করতেন। একসময় সেলবাজার ডটকমে বিজ্ঞাপন দেন। এতে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তখন তাঁর মনে হয়, শুধু একটা বসার জায়গা দরকার।

নিজের দোকানের স্বপ্ন
নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে সুসর্ম্প গড়ে ওঠে সাদেকুলের। গোলাম রাব্বানী একসময় বলেছিলেন, ‘কখনো নিজে দোকান করলে আমাকে জানিও। টাকাপয়সা লাগলে দেব।’ আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। সত্যিই নিউমার্কেটে একটি দোকানের খোঁজ পেয়ে গেলেন। দোকানের অগ্রিম ভাড়ার টাকা গোলাম রাব্বানী দিলেন। চালু হলো সাদেকুলের নিজের দোকান।

সার্ভিসিংয়ের সঙ্গে একসময় টিভি মনিটর বিক্রি শুরু করলেন। সেলবাজার ও বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপক সাড়া পেলেন। তিন বছর আগে এই দোকানটি ছেড়ে দিয়ে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বর্তমান প্রতিষ্ঠানের জায়গায় আসেন। মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। একটি বিক্রয়কেন্দ্র, আরেকটি সার্ভিসিংয়ের জন্য। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘এস-টেক কম্পিউটার’। নিজেদের ওয়েবসাইটও রয়েছে। এখন তাঁর কর্মীরা সার্ভিসিং করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।