কার্ডে কার্ডে সহজ জীবন

মডেল: লাবণ্য, ছবি: কবির হোসেন
মডেল: লাবণ্য, ছবি: কবির হোসেন
>

প্রযুক্তির উৎকর্ষে নগদ টাকায় কেনাকাটার ধারা পরিবর্তন হচ্ছে। জনপ্রিয় হচ্ছে ডিজিটাল লেনদেন। বড়সড় দোকানে কেনাকাটা, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মুহূর্তেই টাকা পাঠানো, অনলাইন দোকান থেকে পণ্য কিনে দাম পরিশোধ করা, স্কুল-কলেজের ফিসহ গ্যাস–বিদ্যুৎ–পানির বিল, মোবাইল ফোনে টাকা ভরা, অ্যাপভিত্তিক যানবাহনের ভাড়া, বাস–ট্রেনের টিকিট কেনাসহ নিত্যদিনের নানা কাজে ডিজিটাল লেনদেনেই করা যায়। ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড এবং মোবাইল ফোনে লেনদেন হয়ে উঠছে জীবনযাপনের অংশ।

চপল চৌধুরী। চাকরিজীবী। প্রতি মাসের বেতনের টাকা তুলতে চেকের পাতা নিয়ে ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যেকোনো অঙ্কের খরচ করেন ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ডে। দৈনন্দিন বাজার কিংবা অন্য কোনো কেনাকাটায় ওয়ালেট ভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যেতে হয় না। বাসায় ফেরার পথে সুপারশপে ঢুকে ব্যাগভর্তি বাজার করেন। আর বিল পরিশোধ করে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে। শুধু তা–ই নয়, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতনও পরিশোধ করেন কার্ডের মাধ্যমে। হাসপাতালের নিজের চিকিৎসার ব্যয়ের বিলও পরিশোধ করেন কার্ড দিয়ে। তিনি বললেন, ‘ডিজিটাল লেনদেন এখন জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। তাই এখন ওয়ালেটে প্লাস্টিকের কার্ড রাখি। এর ফলে অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায়।’

কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে

বর্তমানে ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া সম্প্রতি তিন ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশি ভাগের ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড সেবা রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সুপারশপগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, নগদ টাকার চেয়ে ক্রেতারা ক্রেডিট–ডেবিট কার্ডেই বেশি কেনাকাটা করছেন।

রাজধানীর রামপুরার মহানগর প্রজেক্টে অবস্থিত স্বপ্ন সুপারশপের চেক আউট অ্যাসিস্ট্যান্ট গোলাম কিবরিয়া জানান, ক্রেতারা কার্ডে কিনে বেশি সুবিধা পান। কার্ডে কেনাকাটা করলে ক্রেতাদের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। মূল্যছাড়, ক্যাশব্যাক, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার কেনাকাটায় বিশেষ সুবিধা, কিস্তি সুবিধাসহ সুবিধা ক্রেতাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে থাকে। তাই কার্ডে কেনাকাটাতেই ক্রেতারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।’ শতকরা হিসাবে নগদ টাকা ও কার্ডে কেনাকাটার অনুপাত কেমন, জানতে চাইলে গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘বেশির ভাগ দিন কার্ডে ৬০ আর নগদে ৪০ শতাংশ কেনাকাটা ক্রেতারা করেন। ক্ষেত্রবিশেষ এই অনুপাত ৭০ ও ৩০ শতাংশ হয়ে থাকে।’

নগদ টাকাহীন

দেশের অর্থনৈতিক বাজার ক্যাশলেস অর্থাৎ নগদহীন অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে। দেশের আনাচকানাচে চলে গেছে এই ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা। এতে অধিক মানুষ যেমন ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় এসেছে, তেমনি টাকা স্থানান্তর এখন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। দেশের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ক্যাশলেস লেনদেন ব্যবস্থা, তথা ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ডের ব্যবহার। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংকার এমনকি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও এখন নগদ টাকার ব্যবহার হয় না আগের মতো। এমন অবস্থা শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, বরং বিভাগীয় এবং জেলা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক থানা ও উপজেলায়ও শুরু হয়েছে এমন টাকাহীন বা ক্যাশলেস লেনদেন। এতে বাড়ছে কার্ডের ব্যবহার।

কার্ডে কেনাকাটা করলে নানা সুবিধাও পাওয়া যায়। মডেল: অহনা ও লাবণ্য
কার্ডে কেনাকাটা করলে নানা সুবিধাও পাওয়া যায়। মডেল: অহনা ও লাবণ্য


অনলাইনে কেনাকাটা বাড়ছে

বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বাড়ছে। বাড়িতে বা অফিসে বসে কেনাকাটা, টিকিট বুকিং, বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে। এতে বেশি লাভবান হচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ডিজিটাল লেনদেনে ক্রেতার পরিবহনে ব্যয়ের ক্ষমতা অনেকটা কমে যাচ্ছে। লেনদেন প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা আসছে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল হক বলেন, সারা দেশের প্রায় সাড়ে নয় হাজার পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ই-কমার্স সেবা চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সেবা চালু হয়ে সারা দেশের ই-কমার্সের বিপ্লব হবে এবং কাগুজে টাকাহীন বাণিজ্য সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে।

মোবাইল ব্যাংকিং

ছোট পেমেন্ট বড় ঝামেলা—এমন অসংখ্য অর্থনৈতিক লেনদেন জড়িয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। বিদুৎ, পানি বা অন্য কোনো সেবার বিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন, টিকিট কাটা, চালানের অর্থ, হাসপাতালের বিল, এমন আরও উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে সময় নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। তবে এই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। এখন বাস্তবিক অর্থেই এসব সেবা মুঠোবন্দী। মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএসের মাধ্যমে লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়িয়ে যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে এমন অসংখ্য বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে।

বিকাশে পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেন সৌমেন সাহা। কর্মসূত্রে তিনি ঢাকার নাগরিক। তবে তাঁর পরিবার বসবাস করে রংপুরের একটি গ্রামে। বিকাশে বিল পরিশোধের আগে তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রতি মাসেই বিল পরিশোধ নিয়ে ঝামেলায় পড়তেন। এখন তিনি নিজেই ঢাকা থেকেই পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করছেন। আর পরিবারের প্রয়োজনে বিকাশে টাকা পাঠানো তো তাঁর নৈমিত্তিক ঘটনা।

হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করেন যেসব শিক্ষার্থী, তাঁদের জন্য এমএফএসের ব্যবহার আশীর্বাদ। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমএফএসের মাধ্যমে ফি সংগ্রহ করায় তাদের সময় এবং খরচ বাঁচে। বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। সমাবর্তন বা পুনর্মিলনীর মতো আয়োজনগুলোর ফি এমএফএসে পরিশোধের সুযোগও সহজ করেছে জীবন।

একবারে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানোর সেবা চালু হয়েছে। অর্থাৎ গ্রাহক নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টে নিজেই টাকা পাঠাতে পারবেন। বর্তমানে বিকাশ থেকে ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সেবাও চালু আছে। অসংখ্য গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান/তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন দেয় বিকাশে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গার্মেন্টস কর্মীরা ঢাকার বাইরে পরিবারকে টাকা পাঠান। বেতন পেয়ে নিজের মোবাইল থেকেই টাকা পাঠানো এখন তাঁদের সময় আর খরচ বাঁচায়। কেবল গামেন্টস নয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের দেশব্যাপী বিক্রয়/বিতরণ নেটওয়ার্ক আছে এবং তাদের নিয়মিত কমিশন, বেতন বা অন্য কোনো খরচ পাঠাতে তারাও বিকাশের সেবা ব্যবহার করে। বিকাশ, রকেট, নগদ, আইপের সেবাগুলো এরই মধ্যে পরিচিত আমাদের কাছে। আর এগুলো জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে।

মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার বলেন, অর্থনৈতিক লেনদেনে আমাদের জীবনের অসংখ্য জটিলতাকে একেবারে সহজ করেছে বিকাশের মতো সেবা। যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময় সেবা নেওয়ার সুযোগ থাকায় জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, নিরাপত্তা বেড়েছে। আমাদের পেমেন্ট পোর্টফলিও প্রতিনিয়ত আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। এমন দিন আসবে, যখন একটি মোবাইল দিয়ে একজন ব্যবহারকারী তাঁর সব পেমেন্ট করতে পারবেন অনায়াসে।

মোবাইল প্রতিষ্ঠানের স্মার্ট সুবিধা

জীবনকে আরও সহজ করতে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে এবং দেশের সব প্রান্তের মানুষের হাতে ডিজিটাল সুবিধা পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করছে মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একটি মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল ও টেলিটক ব্যবহারকারীদের জীবন আরও সহজ করতে বিভিন্ন সুবিধা চালু করেছে।

রবির প্রধান ডিজিটাল সার্ভিস কর্মকর্তা শিহাব আহমেদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধের ভোগান্তি দূর করতে চালু করেছি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিল পরিশোধের সুবিধা। বাস, লঞ্চ, সিনেমা বা বড় কোনো অনুষ্ঠানের টিকিট কাটতে মানুষকে আর লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা সহ্য করতে হচ্ছে না, রয়েছে আমাদের বিডিটিকিটস।’ এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের যানবাহনের নিরাপত্তায় রয়েছে রবি ট্র্যাকার।