তারকাদের শক্তিরহস্য

‘রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে/ তারে আমি পাই নাই’—জীবনানন্দ বলছেন ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতায়। জীবনানন্দ কি টের পেয়েছিলেন মানুষের সঙ্গে নক্ষত্রের এই নির্জন সম্বন্ধ, প্রাণের গহিনে লুকিয়ে থাকা নক্ষত্রের নির্জন স্বাক্ষরের কথা? তবে বাংলার এই কবি টের পান বা না পান, মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান নিশ্চিতভাবেই পেয়েছিলেন। ‘আমরা নক্ষত্রের সন্তান’—সাগানের এই বিখ্যাত উক্তিই এ নিশ্চয়তা দেয়। জীবনানন্দ যার নিশানা পেয়েছিলেন বোধের গহিনে ডুবে, সাগান তা–ই করেছেন আবিষ্কার।

সাগানের যুক্তি, মানুষের প্রতিটি কোষে রয়েছে নক্ষত্রের উপাদান। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদি জীবনের জন্য অপরিহার্য। এই উপাদানগুলো দিয়েই গঠিত প্রাণের শরীর। আর এগুলো এসেছে বিস্ফোরিত নক্ষত্র থেকে। যে মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের কথা বলা হয়, যা থেকে এই মহাবিশ্বের যাত্রা, তা থেকেই উৎপন্ন হয়েছে এসব উপাদান।

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউসেরও একই মত। তাঁর ভাষ্য, আমাদের দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু একসময় বিস্ফোরিত নক্ষত্রের ভেতরে লুকিয়ে ছিল।

এ তো গেল মানুষের কথা। আমরা প্রতিনিয়ত যে প্রাকৃতিক শক্তি পাই, তার উৎসও ওই নক্ষত্র। এই যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্য। সূর্য থেকে আমরা তাপ পাই, আলো পাই। আলো হোক আর তাপই হোক, এ দুটি তো শক্তির দুটি ভিন্ন রূপ ছাড়া আর কিছু নয়। এই শক্তিই তরঙ্গের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, আসে আমাদের কাছে এই পৃথিবীতে। এই সূর্যের প্রধান উপাদান হাইড্রোজেন। দ্বিতীয় প্রধান উপাদান হিলিয়াম। এ ছাড়া তুলনামূলকভাবে কম মাত্রায় আছে অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, আয়রন ইত্যাদি।

কথা হচ্ছে, সূর্য এই শক্তি কীভাবে তৈরি করে? সূর্যের ভর প্রচণ্ড। প্রচণ্ড ভরের কারণে সূর্যের ভেতরে তীব্র চাপ তৈরি হয়। প্রবল চাপে হাইড্রোজেন পরমাণু একটির সঙ্গে আরেকটি মিলে যায়। হাইড্রোজেন পরমাণু একীভূত হওয়ার এই প্রক্রিয়াকে বলে ফিউশন। আর এই ফিউশন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় হিলিয়াম। একাধিক পরমাণু যুক্ত হয়ে আগের চেয়ে ভারী পরমাণু উৎপন্ন করার এই প্রক্রিয়ায় একই সঙ্গে নতুন মৌল ও শক্তি পাওয়া যায়। এই শক্তির উৎস হচ্ছে পরমাণুগুলোর কেন্দ্র, যাকে নিউক্লিয়াস বলে। কিন্তু এই ফিউশন প্রক্রিয়া থেকে সব সময় শক্তি পাওয়া যায় না। আয়রন বা লোহার চেয়ে ভারী মৌলের পরমাণুর ক্ষেত্রে ফিউশনের ফলে শক্তির শোষণ হয়। আবার সিসা বা লেডের চেয়ে ভারী মৌলের ক্ষেত্রে ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা, যেখানে বিখ্যাত লেখক চিনুয়া আচেবের জগতের মতো ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’। অর্থাৎ ফিউশন নয়, এবার ফিশানের সময়। এই ভারী মৌলগুলোর নিউক্লিয়াস থেকে শক্তি বিকিরিত হয়, আর উৎপন্ন হতে থাকে কম ভরের মৌল। এই মৌলগুলোকেই তেজস্ক্রিয় মৌল বলা হয়। এ থেকেও আসে বিপুল শক্তি।

এর অর্থ এই নয় যে শুধু তুলনামূলক কম ভরের মৌলগুলোই এসেছে নক্ষত্র থেকে। ভারী মৌলের উৎপত্তিও ওই নক্ষত্রেই। সেখানেই ঘটা বিস্ফোরণ থেকে (স্টেলার এক্সপ্লোশন) আসে স্বর্ণ, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌলগুলো। অতীন্দ্রিয় আলোকচ্ছটার এই নক্ষত্র ও এর বিস্ফোরণকে বলে সুপারনোভা। এই সুপারনোভা অবস্থাকে ব্যাখ্যা করা একটু জটিল। সেদিক এড়িয়ে সাধারণ একটি ব্যাখ্যা বলা যাক। প্রচলিত একটি ব্যাখ্যামতে, নিউট্রন স্টার নামে পরিচিত অতি ঘন বস্তুরাশির সংঘর্ষের ফলেই এই বিস্ফোরণ ঘটে। আর এই অতি ঘন তারকার উৎপত্তি হয় এখনকার সপ্রাণ তারাদের মধ্য থেকেই। জ্বালানি ক্ষয়ে যেতে যেতে, ভারী মৌল উৎপন্ন করতে করতে একসময় জরা এসে ভর করে তার শরীরে। জীবনানন্দের ভাষায়, ‘বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা নিভে যায়’। এই নিভে যাওয়া আদতে আলোহীন হয়ে যাওয়া, যখন তার অতি ঘনত্ব আর আলোর কণাকেও ছাড়তে রাজি হয় না। নিউট্রন স্টার হলো সেসব নক্ষত্র, যারা ভেঙে যাওয়া নক্ষত্রের অবশেষ থেকে তৈরি, যাদের ভর সূর্যের আট বা ততোধিক গুণ বেশি। বিস্ফোরিত নক্ষত্রের কেন্দ্র ভেঙে পড়ার সময় এত উচ্চ চাপ তৈরি হয় যে তাতে সেখানে বিদ্যমান অধিকাংশ নিউট্রন ও প্রোটন একীভূত হয়ে একটিমাত্র নিউক্লিয়াস তৈরি করে। ফলে, এই নতুন তারকা হয় তুলনায় অনেক ছোট, ঘনত্ব হয় অতি উচ্চ। কতটা উচ্চ? এর একটি চিনির দানার মতো অংশের ভর একটি পর্বতের সমান হতে পারে!

অর্থাৎ নক্ষত্রের উদরে চলতে থাকে সব সময় ঘটনার ঘনঘটা। প্রতিনিয়ত চলা এই নিউক্লিয়ার সংযোগ ও বিয়োগ থেকেই উৎপন্ন হতে থাকে সপ্রাণ পৃথিবীর শরীর, এই আমরা, আমাদের অলংকারেরা। কীভাবে? হ্যাঁ, একটি নিউট্রন স্টার হয়তো নতুন কোনো উপাদানের জন্ম দিতে পারে না, কিন্তু দুজন মিলে পারে। দুটি এমন তারকা কাছাকাছি এলে পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে, বিকিরণ করে দুর্বল অভিকর্ষজ তরঙ্গ। আর একসময় তাদের মধ্যে ঘটে সংঘর্ষ, যাকে বলে কিলোনোভা। আর এই কিলোনোভার মধ্য দিয়ে উৎপন্ন হয় ভারী ভরের মৌল। তবে এই কিলোনোভার বিষয়টি এখনো কেতাবেই আছে, এর দর্শন মেলেনি। তবে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মেজগার অবশ্য ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষের প্রমাণ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। হাইড্রা নামে দূরবর্তী এক ছায়াপথে এ সংঘর্ষ হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

ড. মেজগার ওই কিলোনোভার নাম দেন কিলোনোভা জিডব্লিউ ১৭০৯১৭। তাঁর মতে, এই বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে উৎপন্ন হয় বহু উপাদান, যার ভর সূর্যের ভরের ৫ শতাংশের সমান। ছড়িয়ে পড়া অভিকর্ষজ তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে তিনি এ তথ্য জানান। এই বিস্ফোরণের উৎপন্ন হয়েছে ১০ পৃথিবীর সমান স্বর্ণ আর ৫০টি পৃথিবীর সমান প্লাটিনাম।

তবে এ কথা শুনে স্বর্ণবণিকদের চোখ চকচক করে লাভ নেই। কারণ, মানুষের পৃথিবীর এই বহুমূল্য রত্নের অধিকার পেতে হলে পাড়ি দিতে হবে বহু আলোকবর্ষ পথ। তাও কোন ছায়াপথে, কোথায়, তার হদিস মেলা ভার। কারণ, এই কিলোনোভা খুব বিরল ঘটনা। একটি ছায়াপথে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ বছর সময় পরপর একটি কিলোনোভার ঘটনা ঘটে। আগে হয়তো এই সময় কম লাগত। কারণ, আগে ক্ষণজীবী নক্ষত্রের সংখ্যা বেশি ছিল। ফলে, এমন বিস্ফোরণের সংখ্যাও ছিল বেশি।

সে যা-ই হোক, এই শরীর ও চারদিক যে বিচিত্র উপাদান দিয়ে তৈরি, এমনকি এত এত যে অলংকার, তার সঙ্গে সত্যিই যোগ রয়েছে ওই নক্ষত্রপুঞ্জের। এ কারণেই হয়তো মানুষ বরাবরই নক্ষত্রের দিকে তাকিয়েছে দারুণ বিস্ময়ে। সেই মায়া সভ্যতা থেকে এই ভারতবর্ষের মানুষ তারাদের সঙ্গে মিতালি পাতাতে চেয়েছে। ‘যা আছে ভাণ্ডে, তা-ই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’—বাউল দেহতত্ত্বের এই আপ্তবাক্য আরও বেশি করে সত্য হয়ে উঠছে। মহাবিশ্বের সেই চিরচলমান নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার নিশানা নিয়েই চলছে এই মানবভাণ্ড। তাই হয়তো ফাল্গুনের হাওয়ায় মন উদাস হলেই নক্ষত্রের সন্তানেরা তাকায় আকাশে, খোঁজে কোনো নক্ষত্র সারথিকে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট