যে জীবন ডিজিটাল

জীবনযাপনে ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন অনিবার্য এক অনুষঙ্গ। মডেল: মৌসুমী, ছবি: স্মার্ট সময়
জীবনযাপনে ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন অনিবার্য এক অনুষঙ্গ। মডেল: মৌসুমী, ছবি: স্মার্ট সময়

সকালের ঘুম এখন পাখির ডাকে ভাঙে না। এমনকি অ্যালার্ম ঘড়ির বিরক্তিকর শব্দেও নয়। ঘুম টুটে যায় ফোনের খুদে বার্তার আগমনী আওয়াজে। খুদে বার্তাগুলো পাঠায় রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো। সাতসকালে সুখবরই অবশ্য দেয় তারা—‘আপনার আগামী ৫টি রাইডে থাকছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়!’ ফলে অনেকেরই হয়তো সকাল শুরু হয় আনন্দচিত্তে, হাসিমুখে। আনন্দ আর হাসি হয়তো আরও বিস্তৃত হয় যখন চোখ কচলে ফেসবুক খোলার পর দেখা যায় লাইকের সমাহার। আগের রাতে আপ করা একটি ছবিতে শ দুয়েক লাইক–লাভ পেতে কার না ভালো লাগে!

আইপড বা গান শোনানোর এ রকম খুদে যন্ত্রগুলো প্রাতর্ভ্রমণের পুরোনো সঙ্গী। সকালের নতুন সহচরদের দলে যোগ হয়েছে ফিটবিট ও স্মার্টওয়াচ। কত ধাপ হাঁটছেন, হৃৎপিণ্ডটি ঠিকঠাক আছে কি না—সব টুকে রাখে এই যন্ত্রগুলো। ঘরে ফেরার পর এগুলোর খুদে পর্দায় চোখ রাখলে ভালো খবর পেলে তো ভালোই; নাহলে সতর্কতা বেড়ে যায় আরও খানিকটা। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত দুশ্চিন্তা অবশ্য দ্রুতই ঝেড়ে ফেলা যায়। সকালের নাশতাটাও সুস্বাদু হয়ে ওঠে যখন পত্রপাঠমাত্রই অ্যালেক্সা বাজিয়ে দেয় প্রিয় কোনো গান, শুনিয়ে দেয় বিশ্বের তাজা খবর। তখন মনে হয়—জীবন বড় সহজ, ব্রাদার!

কঠিন জীবন অবশ্য অপেক্ষা করে রাজপথে। ধুলাবালু, হাউকাউ, গরম—সব মিলিয়ে যানজটের অসহনীয় ধকল। গুগল সবই জানে। বিকল্প পথ থাকলে তাতে যানজট আছে কি না, তা–ও বাতলে দেয় চোখের পলকে। রাজপথের যুদ্ধ শেষে মনে হয়তো শান্তি এনে দেয় বসের সঙ্গে সফল এক ভার্চ্যুয়াল মিটিং। অফিসের প্রজেক্টরের পর্দায় লাইভে আসা বসের হাসিমুখ আর অদৃশ্য পিঠ চাপড়ানি কার না ভালো লাগে। দুপুরে তাই রোজকার খাবারের চেয়ে নামী রেস্তোরাঁর মুখরোচক কোনো পদের জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করে। ফুড ডেলিভারি অ্যাপগুলো যেন আজকালকার আলাদিনের চেরাগ। চাওয়ামাত্রই কেবল তিন নয়, ততোধিক পদের খাবার চলে আসে দোরগোড়ায়। আবার ছোট বোনটি চাওয়ামাত্রই অনলাইনে টাকা পাঠানো এখন ডালভাতের মতোই সহজ। বিদ্যুৎ বিল বা এ রকম টুকটাক (জটিলও বটে) কাজের জন্য দাঁড়াতে হয় না লম্বা সারিতে। অনলাইন ব্যাংকিং সব এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। বাসা বা অফিসে বসেই মুশকিল আসান।
অফিস থেকে বেরিয়ে বড় বড় বিপণিবিতানের আশপাশে গেলে এবং ফোনের লোকেশন চালু থাকলে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। যত রকম ছাড় আছে তার বার্তা চলে আসে মুঠোফোনে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝকমারির শেষ যে কোথায়, তা কেউ জানে না। আবার সবই জানে মুঠোবন্দী ফোনটা। বাস্তবে নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলে বাসায় ফিরেই হয়তো দেখবেন ফেসবুক ‘পিপল ইউ মে নো’ অপশনে সেই মানুষটিকেই সামনে নিয়ে এসেছে! এসবে বিপদের আশঙ্কা যে নেই, তা–ও হলফ করে বলা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কতাই সর্বোত্তম পন্থা।

বাসায় ফেরার পর রাতের খাবার তৈরির সময় দেখা গেল গরমমসলার ভান্ডটি খাঁ খাঁ করছে। অনলাইনে কেনাকাটার অ্যাপ চালু করলেই হলো। এর মধ্যে নেটফ্লিক্সে একটা টান টান উত্তেজনাময় সিরিয়াল কিংবা ইউটিউবে স্মৃতিকাতর করে দেওয়া গান শোনা যায় দিব্যি। আর রাতের খাওয়া শেষে যখন ভিডিওকলে মায়ের অমলিন মুখটি দেখা যায়, তখন কি মনে হয় না, এই ডিজিটাল জীবনটাও মন্দ নয়!
ডিজিটাল এই জীবন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন সৈয়দ আলমাস কবির। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি তিনি। বললেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তা পুরোপুরি সত্যি হলে জীবন আরও সহজ হবে। এখন গ্রাম পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে যাচ্ছে। অনলাইন সেবা চলে যাচ্ছে সবার দোরগোড়ায়। এর ফলে জীবন যেমন সহজ হবে, তেমনি সব কাজে আসবে স্বচ্ছতা। একই সঙ্গে ডিজিটাল শিল্পের জন্যও এটা বড় সুখবর। সামনে অনেক কাজ হবে। আবার চ্যালেঞ্জও আছে। এই শিল্পে প্রচুর দক্ষ জনশক্তি দরকার। আমরা এখন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস কিংবা ব্লক চেইনের মতো বিষয়গুলো তরুণদের ঠিকভাবে শেখাতে না পারলে আমাদের স্বপ্ন সফল হবে না। তাই এখন থেকেই স্কুলপর্যায়ে এ বিষয়গুলোতে শিশু–কিশোরদের হাতেখড়ি দিতে হবে।’