প্রতারণা নাকি আস্থার জায়গা

অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ততা বাড়ছে। মডেল: সারাকা, ছবি: সুমন ইউসুফ
অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ততা বাড়ছে। মডেল: সারাকা, ছবি: সুমন ইউসুফ

গত সপ্তাহে একটি বিয়ের দাওয়াত ছিল নাজনীনের। চাকরি করেন বলে ব্যস্ত জীবন তাঁর। তবে সামাজিক অনুষ্ঠানে একটু পরিপাটি হয়ে যেতে চান। বিয়ের অনুষ্ঠানের এক দিন আগে খেয়াল করলেন, শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে জুতসই গয়না নেই। হাতে সময়ও নেই দোকান ঘুরে ঘুরে গয়না কেনার। অনলাইন সেবা ব্যবহার করে সন্তুষ্ট বলে তিনি প্রায়ই অনলাইনে পোশাকসহ বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটা করেন। সেই অভ্যাসে অনলাইনে ঢুকলেন গয়না খুঁজতে। পছন্দও করলেন একটি। কিন্তু হতাশ হলেন এই ভেবে যে গয়না অর্ডার করেই বা কী লাভ, এক দিনের মধ্যে নিশ্চয় কেউ তা হাতে পৌঁছে দেবেন না। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পছন্দের গয়না ক্লিক করে দাম জানতে চাইলেন। ফেসবুক মেসেঞ্জারে উত্তর আসার পর নিশ্চিত হতে চাইলেন, এক দিনে পাবেন কি না। পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি জানাল, ঢাকা থেকে অর্ডার পেলে পণ্য মজুত থাকলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জরুরি সেবামূল্য নিয়ে গয়না সরবরাহ করতে পারেন। পরদিন কাঙ্ক্ষিত গয়নাটি অফিসে বসেই হাতে পেয়ে গেলেন নাজনীন।

এখন নাগরিক জীবনযাপনে যুক্ত হয়েছে অনলাইন কেনাকাটা। স্মার্ট জীবনযাপনে সময় বাঁচাতে ও প্রয়োজনে শহরের পাশাপাশি মফস্বলেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ তালিকায় কী নেই! গয়না, পোশাক, মুঠোফোন, চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, প্রস্তুত করা খাবার, বই, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ওষুধ ইত্যাদি।

শুধু পোশাক বা গয়না নয়, বাড়ির জন্য চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্য এখন অনলাইনে কিনছেন রাজধানীর ধানমন্ডির মিল্টন আহমেদ। অনলাইনে বইয়ের ফরমাশ দিয়ে বই কিনেছেন মিরপুরের সালাউদ্দিন। ঘরে বসে প্রায়ই খাবারের ফরমাশ দেন রনি আলম। তবে সব সময় কি ভালো অভিজ্ঞতা হয় অনলাইন কেনাকাটায়।
প্রিয়শপ ডটকমের প্রধান নির্বাহী আশিকুল আলম খান বলেন, ই–কমার্সের সব থেকে বড় সুবিধা হলো মানুষের কর্মঘণ্টা বাড়িয়েছে। পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিক্রয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে অনলাইন কেনাকাটা। স্মার্টফোনটি এখন যেন বাজার।

ডিজিটাল যুগে গ্রাহকদের পণ্যের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে খোলা হচ্ছে নানা রকম অনলাইন শপ। যেমন: শুধু ঘরে বসে যেকোনো পণ্য কেনার জন্য রয়েছে একধরনের সাইট, আছে ব্র্যান্ড দোকানগুলোর অনলাইন শপিং, কাউকে উপহার দিতে চাইলেও রয়েছে আলাদা কিছু সাইট। আবার কারও যদি কেনাবেচা—দুটোরই ইচ্ছে থাকে, তাহলে ঘুরে আসতে পারেন শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের (ক্লাসিফায়েড) ওয়েবসাইটগুলোতে। ঘর সাজানো থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিও কেনার প্রতি আগ্রহ দেখা যায় এখন। দেশে ২ হাজারের বেশি সাইট রয়েছে। এর বাইরে ফেসবুক পেজভিত্তিক শপ রয়েছে ২০ হাজারের বেশি। দেশে ই–কমার্স সাইটগুলোর সংগঠন ই–ক্যাবের সদস্যসংখ্যা ৯০০।
ঘরে বসেই কাঙ্ক্ষিত পণ্য কেনার সুযোগ থাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন শপগুলো। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে অনলাইন কেনাকাটা সাড়া ফেলেছে তরুণদের মধ্যে। পয়লা বৈশাখ, ঈদ বা যেকোনো বড় উপলক্ষ সামনে রেখে অনলাইন শপের কদর বেড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে ঢাকার বাইরে ছোট শহরের অনেকেও অনলাইনে কেনাকাটা করেন। তেমনই একজন চুয়াডাঙ্গার তানিয়া আকতার।
তানিয়া জানান, তিনি প্রায়ই অনলাইন থেকে পোশাকসহ বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী কেনেন। এখন অনেকেই ফেসবুক লাইভে পণ্য বিক্রি করেন। সেগুলো থেকে কিছু পছন্দ হলে কিনে ফেলেন। অর্থ পরিশোধ করেন তাঁর বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঝামেলা ছাড়াই কেনাকাটার সুবিধার কারণে অনলাইনের বাজার পরিধি বাড়ছে। তা ছাড়া এ ব্যবসায় লোকজন কম লাগে, বিক্রির জন্য বড় দোকানের প্রয়োজন হয় না। ই–কমার্সের ক্ষেত্রে প্রিয়শপ ডটকম, বাগডুম ডটকম, আজকের ডিল ডটকম, চালডাল ডটকমের মতো সাইট যেমন আছে, তেমনি বইয়ের ক্ষেত্রে রকমারি ডটকম, প্রথমা ডটকম; খাবারের ক্ষেত্রে ফুডপান্ডা, হাংরি নাকি; পণ্যের ক্ষেত্রে দারাজ, পিকাবু, ই–প্লাজার মতো নানা সাইট এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

দেশে এখন ই-কমার্স ওয়েবসাইটের বাইরেও ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ খুলে বেচাকেনা করছেন অনেকে। বিভিন্ন শপিং মলের দোকানিরা ফেসবুকে পেজ খুলে নিজেদের দোকানের পণ্যের প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি বেচাকেনাও করেন। রেনে বাংলাদেশ নামের একটি পেজের অ্যাডমিন সানজানা বলেন, তাঁরা ফেসবুকের মাধ্যমে চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করছেন। এখান থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা।

সব সময় সুখকর নয়
অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে অনেকে সন্তোষ প্রকাশ করলেও এ নিয়ে অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। অনেকে অনলাইনে দেখানো পণ্যের সঙ্গে সরবরাহ করা পণ্যের মিল পান না। মিরপুরের রূপনগরের বাসিন্দা নাজমুস সাকিব বললেন, ‘ছবি দেখে অনলাইনে বেল্ট কিনেছিলাম। কিন্তু ছবির সঙ্গে পণ্যের মিল পাইনি।’ তাঁর মতে, অনলাইন শপগুলোতে দামের ক্ষেত্রে প্রতারণা করা হয়। সাইটে পণ্যের দামে অনেক সময় ছাড় দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছাড়সমেত দামটিই বাজারের দাম।
মতিঝিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইলিয়াস কবীরের অনলাইন কেনাকাটার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। স্ত্রীর জন্য থ্রিপিস কিনেছিলেন ফেসবুক শপ থেকে। কিন্তু পোশাকটি হাতে পাওয়ার পর দেখেন ফেসবুকে দেখানো থ্রিপিসের সঙ্গে তাঁকে পৌঁছে দেওয়া পণ্যের ব্যাপক পার্থক্য।

তবে অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণা আগের চেয়ে এখন অনেক কমে গেছে বলে দাবি করেছেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) যুগ্ম সম্পাদক নাসিমা আকতার। তিনি জানান, এখন ই-ক্যাবের ফেসবুক গ্রুপে অভিযোগ দিলেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউ প্রতারিত হলে প্রথমে ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে ক্রেতা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলা হয়। দেশে প্রতিদিন অনলাইন ডেলিভারির সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজার।
ই–ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ব্যবসা বাড়াতে সাপোর্ট সেন্টার ও প্রশিক্ষণের মতো ব্যবস্থা করেছে ই–ক্যাব, তেমনি প্রতারণার শিকার হলে ই–ক্যাবের সাইটে জানানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ
বাংলাদেশ হাইকোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণার শিকার হলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সাইট ও কী ধরনের প্রতারণার শিকার হলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে পণ্য কেনা বা হাতে পাওয়ার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়েও মোকদ্দমা করা যায় আদালতে। করা যায় প্রতারণার মামলাও। কিন্তু ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করাটা সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ। অধিদপ্তর অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতার প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা প্রদানের আদেশ দেবে। এ জরিমানা হিসেবে যে টাকা আদায় করা হবে, তার ২৫ শতাংশ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি অবগত করা যায়।

এ বিষয়ে ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, ‘অনলাইন প্রতারণার শিকার যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি থানায় অভিযোগ জানাতে পারবেন। এ জন্য মামলা করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে ভিকটিম আইনগত প্রতিকার পাবেন। আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

সচেতনতাই ভরসা
* পণ্যের বিবরণ ভালোভাবে পড়ে নিন। এর সঠিক বাজারদর জেনে নিন।
* পর্যালোচনা বা রিভিউ থাকলে পড়ে নিন। আকর্ষণীয় অফার দেখেই হুট করে কিনতে যাওয়া ঠিক নয়।
* বিক্রেতা অনুমোদিত বা বৈধ পথের পণ্য বিক্রি করছে কি না তা দেখে নিন।
* দেখে নিন প্রতিষ্ঠানটির অফিস, গ্রাহকসেবার ফোন নম্বর আছে কি না। সব সময় বিশ্বাসযোগ্য জায়গা থেকে কিনুন।
* পণ্য বদল বা ফেরত দেওয়ার নীতিমালা কী, একবার দেখে নিন।
* বিক্রয়োত্তর সেবা আছে এমন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনা উচিত।
* দেখে নিন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রিভিউ আছে কি না। সেই সঙ্গে আপনিও জানান আপনার অভিজ্ঞতা। এতে অন্য ক্রেতার সুবিধা হবে।
* প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনলে প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। বড় প্রতিষ্ঠান সুনামের ব্যাপারে সচেতন থাকে।
* দরকার হলে ভোক্তা অধিকারে মামলা করতে পারেন, এতে কোনো অর্থ খরচ হয় না।