স্মার্টফোন বিক্রি নিয়ে বিপাকে বিক্রেতারা

নতুন স্মার্টফোনে আগ্রহ কমছে। ছবি: রয়টার্স
নতুন স্মার্টফোনে আগ্রহ কমছে। ছবি: রয়টার্স

স্মার্টফোনের বাজারে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। নামীদামি ফোন বাজারে আসছে ঠিকই, কিন্তু এর নির্মাতারা খুশি নন। কারণ, এসব ফোন কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে মানুষ। একে তো দাম বেশি, তারপরও নতুনত্ব কম। বাজারে প্রতিযোগিতাও কম নয়। ঘন ঘন ফোন বদলের পক্ষেও নয় মানুষ। তাহলে কী করবেন ফোন বিক্রেতারা?

আইফোন নির্মাতা অ্যাপলের দিকে তাকান। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাপক বিক্রি কমেছে অ্যাপলের আইফোনের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই প্রযুক্তি জায়ান্ট এর আগে আইফোনের এত কম বিক্রি আর দেখেনি। ২০১৮ সালের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ১৭ শতাংশ বিক্রি কমেছে তাদের। তবে অদ্ভুতুড়ে বিষয়টি হচ্ছে, অ্যাপল এতে নাখোশ নয়।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, চলতি বছরের শুরুতেই বিক্রি কমে যাবে—এমন পূর্বাভাস দিয়েছিল অ্যাপল। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, চীনে বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ, সেখানে অপেক্ষাকৃত কম দামি হুয়াওয়ে ও শাওমি ফোন কোম্পানির সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে আইফোনকে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, চীনে অ্যাপলের আইফোন বিক্রি গত প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কমেছে ২০ শতাংশ।

অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক বলেছেন, মার্চের শেষ দিক থেকে বিক্রি বেশ বাড়তে শুরু করেছে। চাহিদা বাড়ানোর জন্য তাদের কৌশলগুলো কাজে লেগেছে। ওয়াল স্ট্রিটের পূর্বাভাস বলছে, অ্যাপল আবার ঘুরে দাঁড়াবে। এতে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বাড়ছে। তবে স্মার্টফোনের বিক্রি কমে যাওয়ার অস্বস্তিকর খবরটি অ্যাপলসহ স্মার্টফোন নির্মাতাদের ভাবাচ্ছে বেশি।

বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ স্মার্টফোন বিক্রি কমে গেছে। একই সুরে কথা বলেছেন গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই। তাঁর মতে, এখন স্মার্টফোন নির্মাতাদের জন্য আগের চেয়ে দামি হাই-এন্ড ফোনগুলো বিক্রি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া স্মার্টফোনের বাজারে প্রতিযোগিতা এখন এতটাই বেশি যে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে স্মার্টফোন নির্মাতাদের ওপর বাজারের দখল ধরে রাখতে চাপ বাড়বে। স্মার্টফোন নির্মাতারা সেখান থেকে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে পারবে কি না, তা দেখার দেখার বিষয়।

২০১৭ সালের দিকে যদি একটু ফেরা যাক। ওই সময় জানা গেল, ব্যবহারকারীরা এখন সহজে তাঁদের ফোন পরিবর্তন করছেন না। একটি স্মার্টফোন দীর্ঘদিন ব্যবহার করছেন তাঁরা। ২০১৮ সালে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাভেরিক ক্যাপিটাল বলেছিল, স্মার্টফোনের নতুনত্ব বা উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্যের বিপ্লব আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। নতুন আর পুরোনো মডেলের স্মার্টফোন পার্থক্য থাকে সামান্যই। এ ছাড়া নতুন স্মার্টফোন কেনার ক্রেতা খুঁজে বের করা কঠিন। অনেকের হাতেই এখন স্মার্টফোন পৌঁছে গেছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্মার্টফোনের বাজার যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ মানুষের হাতে এখন স্মার্টফোন। তাহলে নতুন ফোন বিক্রির জায়গা কোথায়? বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন স্মার্টফোন বিক্রির জায়গা কম। অন্য পথ ধরতে হবে।

বিভিন্ন স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এরপর থেকে বিভিন্ন কৌশলে স্মার্টফোন বিক্রির ধীরগতি ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া ডিভাইসের বাইরে অন্যান্য সেবার দিকেও ঝুঁকে পড়ছে। এর উদাহরণ টানতেও অ্যাপলকে আনা যেতে পারে। অ্যাপল মিউজিক, আইক্লাউড, অ্যাপল প্লের মতো নানা সফটওয়্যার সেবা ব্যবসা দ্বিগুণ করে তাদের আয় বাড়াচ্ছে। আইফোন ব্যবহারকারীর কাছ থেকে বেশি আয়ের লক্ষ্যে ডিভাইস বিক্রির পাশাপাশি এসব ব্যবসাতেও গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে অ্যাপল টিভি প্লাস স্ট্রিমিং সেবা বা অ্যাপল কার্ডের মতো ব্যবসাকেও গ্রাহকের কাছে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এটা অ্যাপলের জন্য ইতিবাচক ফল এনেছে। এ বছর তাদের এ সেবা খাত থেকে ১৬ শতাংশ বাড়তি আয় এসেছে।

পিছিয়ে নেই স্যামসাং, হুয়াওয়ে, মটোরোলার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। স্মার্টফোনে বাজারে এগিয়ে থাকতে নানা নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করছে তারা। এর মধ্যে দ্রুতগতি ৫জি ওয়্যারলেস ইন্টারনেট, ভাঁজ করা বা ফোল্ডেবল ডিভাইসের মতো নানা উদ্ভাবন রয়েছে। এ বছরেই ৫জি নেটওয়ার্ক–সমর্থিত গ্যালাক্সি এস১০ মডেলের স্মার্টফোন আনতে পারে স্যামসাং। এ ছাড়া গ্যালাক্সি ফোল্ড স্মার্টফোন বাজারে আনার বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।

বাস্তবতা বিবেচনা করলে ৫জি নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে চালু হতে বেশ দেরি আছে। এ ছাড়া গ্যালাক্সি ফোল্ড নামের ভাঁজ করা ফোন ঘিরে যে আগ্রহ ছিল, তাও মিইয়ে যেতে শুরু করেছে। গ্যালাক্সি ফোল্ড টেকসই নয় বলে মন্তব্য করেছেন কয়েকজন পর্যালোচনাকারী। অর্থাৎ এখনো বাজারে আসার মতো প্রস্তুত নয় ভাঁজ করা স্মার্টফোন।

বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, স্মার্টফোনের বাজারের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এর দাম। দিনকে দিন ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনগুলোর দাম হচ্ছে আকাশছোঁয়া। স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি এস১০ মডেলটির দাম শুরু ৯০০ মার্কিন ডলার থেকে। আইফোন এক্সএস মডেলের দাম শুরু ৯৯৯ মার্কিন ডলার থেকে। ভবিষ্যতে ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনগুলোর দাম আরও চড়া হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ৫জি–সমর্থিত এস১০–এর দাম হবে ১ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার আর ভাঁজ করা ফোল্ডের দাম হবে ১ হাজার ৯৮০ মার্কিন ডলার।

ফোনের নকশা আর প্রযুক্তিতে নতুনত্ব থাকলেও তা মানুষকে আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট নয়। কারণ, এসব ডিভাইসে যেসব অ্যাপ বা ওয়েবসাইট চলবে তা কম দামের ফোনেও চালানো যাবে। কার্যক্ষমতার দিক থেকে মানে যা সামান্য পার্থক্য তৈরি করে। এর বাইরে কম খরচে শাওমি, ওয়ানপ্লাসের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান ভালো মানের ফোন বাজারে ছাড়ছে। তাই স্মার্টফোন বাজারের খুব বেশি ওঠা-নামা না থাকলেও এর পুরোনো রমরমা দিনগুলো মলিন হতে শুরু করেছে—এ কথা বলাই যায়।

অবশ্য নিরাশার মধ্যে আশার আলোও রয়েছে। স্মার্টফোনের পরে কী আসবে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে এখনই। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির প্রতিটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানেই অগমেন্টেড রিয়্যালিটির (এআর) মতো প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা চলছে। এআর প্রযুক্তি মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট বাস্তব জগতে প্রদর্শন করা যায়। এ খাতে অ্যাপল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, স্যামসাং, গুগলের সমর্থনযুক্ত ম্যাজিক লিপ, গেম নির্মাতা ফোর্টনাইটের মতো প্রতিষ্ঠান এআরকে পরবর্তী কম্পিউটিং ইন্টারফেস হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। মাইক্রোসফট ও ম্যাজিক লিপ বাজারে এআর চশমা উন্মুক্ত করেছে। অ্যাপলও শিগগিরই এমন প্রযুক্তি আনবে।

স্মার্টফোনের বাজারের ধীরগতির কারণে এআরের পেছনে ছুটতে শুরু করেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ খাতটি স্মার্টফোনের পরে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। এ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের যথেষ্ট কারণও তাই। তবে সমস্যা হচ্ছে, স্মার্টফোনের জায়গা নিতে পারে—এমন কোনো অবস্থানে আসতে পারেনি এআর প্রযুক্তি। এ ছাড়া এগুলোর দামও নাগালের বাইরে। মাইক্রোসফটের তৈরি হলোলেন্সের দাম ৩ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।

স্মার্টফোনের জায়গা নেওয়ার মতো নতুন কোনো প্রযুক্তি শিগগিরই যে আসছে না, তা ধারণা করাই যায়। স্মার্টফোনের বদলি হতে গেলে ক্রেতাদের হাতের নাগালে তার দাম হতে হবে। প্রযুক্তি হতে হবে সাড়া জাগানো। তবেই মানুষ তা গ্রহণ করবে।