পরনে প্রযুক্তি

ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফ্যাশনোলজি সামিটের ফ্যাশন শোতে পরিধেয় প্রযুক্তির পোশাক পরে হাঁটেন মডেলরা। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফ্যাশনোলজি সামিটের ফ্যাশন শোতে পরিধেয় প্রযুক্তির পোশাক পরে হাঁটেন মডেলরা। ছবি: সংগৃহীত

স্মার্ট দুনিয়ার পোশাক হবে স্মার্ট। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে মানুষজন অল্পবিস্তর স্মার্ট পোশাক পরছেন। স্মার্ট পোশাক আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিতও নয়। তাতে কি। চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় প্রথমবারের মতো স্মার্ট পোশাক তৈরি হয়েছে।

হ্যাঁ, তাক লাগানোর মতো ঘটনাই বটে। তবে অসাধ্য এই কাজ করে দেখিয়েছেন দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের তরুণ উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ উদ্দিন। মূলত তাঁর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ দুই বছর ধরে ঢাকায় ফ্যাশনোলজি সামিটের আয়োজন করছে। সেই সম্মেলনে দেখানোর জন্যই কর্ণফুলী ইপিজেডে মোস্তাফিজের পোশাক কারখানা ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডে ২০টি স্মার্ট পোশাক প্রস্তুত করা হয়। সে জন্য বেশ কিছু উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করে আনা হয়।

রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় ২ মে ফ্যাশনোলজি সামিট অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ১৫টি দেশের ৪১ জন বিশেষজ্ঞ আলোচক অংশ নেন। তাঁরা স্মার্ট পোশাকের ভবিষ্যৎ বাজারের নানা বিষয়ে কথা বলেন। শেষে ফ্যাশন শো ডিজিটাল টেক রানওয়েতে মডেলরা স্মার্ট পোশাক পরে ক্যাটওয়াক করেন।

ঢাকার মঞ্চে আগামী দিনের পোশাক
ঢাকার মঞ্চে আগামী দিনের পোশাক

সাধারণ পোশাকের সঙ্গে স্মার্ট পোশাকের পার্থক্য জানতে চাইলে মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘স্মার্ট পোশাকে তথ্যপ্রযুক্তি বিভিন্ন বিষয় যুক্ত থাকে। যেমন আপনার মুঠোফোন চার্জ করার জন্য পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে ঘুরতে হবে না। পোশাকের মাধ্যমেই মুঠোফোন চার্জ হবে। খুদে বার্তা (এসএমএস) পড়ার জন্য মুঠোফোন পকেট থেকে বের করতে হবে না। এসএমএস এলে তা শার্টের হাতায় পড়া যাবে।’ বৈশ্বিক বাজারে অল্প কিছু স্মার্ট পোশাক বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হচ্ছে। তবে স্মার্ট পোশাক নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা হচ্ছে। আগামী দিন হবে স্মার্ট পোশাকের। সে জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। সেই কাজ শুরু করেছেন মোস্তাফিজরা।

মোস্তাফিজ উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে স্মার্ট পোশাক তৈরির কাজটি সমন্বয় করেছেন বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের পরিচালক ফারুক হোসেন। ৮ মে তিনি শোনালেন সেই স্মার্ট পোশাক তৈরির পেছনের গল্প। বললেন, ‘গতবারের ফ্যাশনোলজি সামিটে প্রদর্শনের জন্য লন্ডনের ডিজাইন প্রতিষ্ঠান লেবেলড বাইয়ের কাছ থেকে স্মার্ট পোশাক এনেছিলাম। তবে চলতি বছর আমরা নিজেরাই করার পরিকল্পনা করি। সে জন্য গত মার্চে লন্ডনে গিয়ে লেবেলডবাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করি। তাদের কাছ থেকে আমরা কারিগরি বিষয়গুলো ভালো করে বুঝে নিই।’

বিদেশ থেকে স্মার্ট পোশাকের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নিয়ে আসার পর গত মাসে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্টের কারখানায় কাজ শুরু হয়। ডেনিম এক্সপার্ট কারখানায় যে শ্রমিকেরা জিনস প্যান্ট সেলাই করেন, তাঁদের কয়েকজনকে দিয়েই স্মার্ট পোশাক তৈরি করা হয়। প্রথমে তিন-চারটি পোশাক নষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত ২০টি পোশাক প্রস্তুত করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্টের কারখানায় তৈরি হচ্ছে এলইডি বাতি ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশযুক্ত পোশাক
বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্টের কারখানায় তৈরি হচ্ছে এলইডি বাতি ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশযুক্ত পোশাক

ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমাদের পোশাকশ্রমিকেরা খুবই দক্ষ। তাঁদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি দিলে সব ধরনের পোশাকই তৈরি করা সম্ভব। অথচ লেবেলডবাইয়ের ডিজাইনাররা শুরুতে আমাদের বলেছিলেন, তোমাদের পোশাক বানাতে হবে না, আমরাই লন্ডন থেকে সরবরাহ করব। তবে আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল, আমরা পারব। আমরা তাঁদের বলেছিলাম, তোমরা কেবল প্রশিক্ষণ ও টেকনোলজি দাও। আমরা করে দেখাব।’

অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের এই পরিচালক বলেন, ‘আমরা আমাদের কারখানায় থ্রি-ডি প্রিন্টের পোশাক তৈরি করেছি। আমাদের দেশে যেহেতু ত্রিমাত্রিক ছাপার সুযোগ নেই, তাই দেশের বাইরে থেকে প্রিন্ট করে এনে দেশে সংযোজন করা হয়েছে। তা ছাড়া সোলার বা সৌরবিদ্যুতের প্যানেলের পোশাক, লেজার কাটের পোশাক ও এলইডি বাল্বের পোশাক আমরা তৈরি করেছি। এলইডি বাল্বের পোশাকের বাতিগুলো বিভিন্ন সময় রং পরিবর্তন করে।’

পোশাকে এলইডি বাতির উজ্জ্বল আভা
পোশাকে এলইডি বাতির উজ্জ্বল আভা

ফ্যাশনোলজি সামিটে ডিজিটাল টেক রানওয়ে নামের ফ্যাশন শোতে ডেনিম এক্সপার্ট কারখানায় তৈরি পোশাক প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা স্মার্ট পোশাকও ছিল। তার মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য সোলার প্যানেলযুক্ত স্মার্ট পোশাক ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী টি-শার্ট।

সোলার বা সৌরবিদ্যুতের প্যানেলযুক্ত পোশাক পরলে সহজেই পকেটে পুরেই নিজের মুঠোফোন চার্জ দেওয়া যাবে কিংবা সাইক্লিংয়ের জন্য মাথার হেলমেটের ছোট্ট বাতিটি জ্বালানো যাবে। তা ছাড়া জগিংয়ের সময় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট টি-শার্ট তৈরি করা হয়েছে। পোশাকটি নিজে নিজেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে। আবার শরীরের সুগার ও হৃৎস্পন্দন মাপার জন্য বর্তমানের স্মার্ট ঘড়ির বদলে আছে বিশেষ টি-শার্ট। সেটি নিজে থেকেই শরীরের সুগার ও হৃৎস্পন্দন পরিমাপ করে তথ্য দিতে পারবে।

বিশ্বের লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলো স্মার্ট পোশাক তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বর্তমানে পরীক্ষার-নিরীক্ষার পর্যায়ে থাকলেও স্মার্টস্পোর্টসওয়্যার বিক্রি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। সব মিলিয়ে স্মার্ট পোশাকের বৈশ্বিক বাজার বর্তমানে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২৫ সালে বাজারটি বেড়ে ১৩ হাজার কোটি বা ১৩০ বিলিয়ন ডলার হবে।

ভবিষ্যতে পোশাক রপ্তানিতে টিকে থাকতে হলে স্মার্ট পোশাক তৈরি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন মোস্তাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের পোশাক সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের দেশের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রস্তুত করার জন্যই আমরা দুই বছর ধরে ফ্যাশনোলজি সামিট করছি। আমাদের উদ্যোগের কারণে অনেকেই স্মার্ট পোশাক তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’