ইউটিউবে 'পুলিশিং' সম্ভব?

ইউটিউব লোগো
ইউটিউব লোগো

নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় দুটি বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। শুরু হয়েছে ‘পুলিশিং’ বা কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব কর্তৃপক্ষ নজরদারিতে ব্যাপক জোর দিচ্ছে।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ভিডিওটি সরাসরি সম্প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ কাজে ব্যর্থ হয় বিশ্বের বৃহত্তম ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব। এর মধ্যেই শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। ফলে ভিডিও প্ল্যাটফর্মসহ এ ধরনের মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে।

গত ১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজের সময় আল নুর ও লিনউড মসজিদে বন্দুক হামলা চালান অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্রেনটন টারান্ট (২৮)। ওই হামলায় ৫০ জন নিহত হন। দুই মসজিদের মধ্যে আল নুরে হামলার সময় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের স্বঘোষিত অনুসারী ব্রেনটন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করেন। ঘটনা জানার পর থেকেই ওই ভিডিও সরিয়ে ফেলতে দ্রুত পদক্ষেপ নেন ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুজান ওজসিসকি। কর্মী ছাড়াও তাঁদের মেশিন লার্নিং (এমএল) প্রযুক্তি কাজে লাগান। বন্ধ করে দেওয়া হয় এ-সংক্রান্ত নতুন ভিডিও সার্চ। কিন্তু ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।

সহিংস ভিডিও সম্প্রচার হওয়ার পর থেকে ইউটিউবে নানাভাবে আবার ফিরে এসেছে। ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী ওজসিসকি নিজেও তা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন, পুরোনো ভিডিও শনাক্ত করে মুছে ফেলতে না ফেলতে আরেকভাবে তা আপলোড হয়ে যায়। এর সমাধান কি নেই? এর সমাধান হচ্ছে কঠোর ‘পুলিশিং’ ব্যবস্থা।

লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সহিংস, আপত্তিকর বিষয় ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাকে পুলিশিং ব্যবস্থা বলা হচ্ছে। এ ধরনের পুলিশি ব্যবস্থা নিতে ইউটিউব ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের ওপর চাপ বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো তাদের পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনুক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের ক্ষেত্রে পুলিশিং করার তাগিদ দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তবে এ পুলিশিং ব্যবস্থা ইউটিউবে চালু করা কিছুটা জটিল। প্রতি মিনিটে এ সাইটে ৫০০ ঘণ্টার মতো ভিডিও আপলোড হচ্ছে। তরুণ ও কিশোরেরা তা দেখছে। ইউটিউবের ভিডিও এখন খবরের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম এখন ইউটিউব। এ ক্ষেত্রে ফিল্টারিং বেশি হয়ে গেলে মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলেও আওয়াজ উঠছে।

ওজসিসকি মনে করছেন, ইউটিউবের জন্য পুলিশিং সিস্টেম বের করতে পারবেন তাঁরা। তাঁর ভাষ্য, ‘এখন পর্যন্ত যা কেউ করতে পারিনি, তা আমরা পারব। এ সমস্যার সমাধান দ্রুতই বের করে ফেলব বলে আশাবাদী।’

প্রশ্ন হচ্ছে, ইউটিউব তাদের ভিডিও কনটেন্ট মাত্রাতিরিক্ত পর্যালোচনা করলে এবং সরকার তাদের এ কাজে বাধ্য করলে বিশ্বের জনপ্রিয় এ সাইটটিতে তার প্রভাব পড়তে শুরু করবে। তবে, এ পুলিশিং ব্যবস্থা এ সিস্টেমকে একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামোর মধ্যে আনবে বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

২০০৫ সাল থেকে মানুষের জন্য নতুন ধরনের বিনোদন ব্যবস্থা হিসেবে উঠে এসেছে ইউটিউব। ব্যবহারকারীর তৈরি করা ভিডিও সবার জন্য দেখার সুযোগ তৈরি হয় ইউটিউবে। বিশ্বজুড়ে বিনা মূল্যের টিভি সেবা এখন ইউটিউব। মাসে অন্তত একবার হলেও বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষ ইউটিউবে ঢোকে। বিশ্বের মোট ব্যান্ডউইডথের ১১ শতাংশ ব্যয় হয় ইউটিউবের পেছনে। এর ব্যবসাও মন্দ নয়। যদিও ইউটিউবের পক্ষ থেকে আয়ের বিষয়টি প্রকাশ করা হয় না। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মিডিয়া রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ১ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে ইউটিউব। এ সাইট থেকে ভিডিও কনটেন্ট নির্মাতারও আয় করার সুযোগ পান। তবে, ভিডিও নির্মাতাদের অনেকেই বিতর্কিত কনটেন্ট ছড়াচ্ছেন বলেও সমালোচনার মুখে পড়েছে ইউটিউব।

ইউটিউবের ব্যাপক জনপ্রিয়তা এর কনটেন্ট পর্যালোচনার বিষয়টিকে কীভাবে আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়, সে প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। ইউটিউবের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিতর্কিত কনটেন্ট সাইটে রাখার ফল হাতেনাতে পেয়েছে ইউটিউব। একসময় বিজ্ঞাপনদাতারা জোট বেঁধে ইউটিউব বিজ্ঞাপন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে নীতিমালা কঠোর করে তুলেছে ইউটিউব। সেন্সরশিপ আরোপ নিয়ে যতই কথা উঠুক না কেন, আগে তো ব্যবসা! গত বছরে বন্দুক প্রদর্শনসংক্রান্ত ভিডিও বন্ধ করার ঘোষণা দেয় ইউটিউব। এ বছরের জানুয়ারিতে ভুয়া খবর ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণাও এসেছে।

গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই বলেছেন, ‘ইউটিউব জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসা মানে এর দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া। ভবিষ্যতে আরও পরিবর্তন আসবে ইউটিউবে।’

এত সহজে ইউটিউব পুলিশিং চালু করেনি। গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে দেশটির সরকার অগ্রহণযোগ্য কনটেন্টের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সরকার ভুয়া খবর ছড়ানো ঠেকাতে ইউটিউবসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়া সরকার ঘৃণিত সহিংস উপাদান সরিয়ে নেওয়াসংক্রান্ত আইন পাস করেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাই বলা যায়, বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পুলিশিং আরও জোরদার হবে।

ওজসিসকি বলেন, বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে তা যেন চিন্তাপ্রসূত হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।