উত্তপ্ত বিশ্বে খাদ্যশস্যের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

গত দেড় শ বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইডের ঘনত্ব ২৮০ পিপিএম থেকে বেড়ে ৪১০ পিপিএমে দাঁড়িয়েছে। খবরটিতে পরিবেশবিদদের কপালে দেখা দিয়েছে ভাঁজের রেখা। তবে কৃষকদের জন্য এটা কিছুটা সুখবরও বলা চলে। কারণ, কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার মানে গাছের ফটোসিনথেসিস (গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া) বেড়ে যাওয়া। এতে খাদ্যশস্যের উৎপাদনও বেড়ে যায়। 

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রায় ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে কার্বন ডাই–অক্সাইডের এই বৃদ্ধি নিকট ভবিষ্যতে ফসলের ওপর ঠিক কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে বিপত্তির বিষয় হলো, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার যেকোনো পরিবর্তনে ফসলের ওপর প্রভাব সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তও নেয় বিজ্ঞানীদের কাছে।

ফলে ভবিষ্যতে ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। ইতিহাস জানাচ্ছে, হঠাৎ মহামারিতে ১৮৪০–এর দশকে একবার আয়ারল্যান্ডের আলু উৎপাদন থমকে যায়। অজানা এক ছত্রাক আক্রমণ চালিয়েছিল আলুর ওপর, যদিও ওই ছত্রাক এসেছিল মেক্সিকো থেকে। সেবারের ওই আক্রমণে আয়ারল্যান্ডে কয়েক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায় আলুর উৎপাদন, যা ডেকে এনেছিল এক মহাদুর্ভিক্ষ। ওই দুর্ভিক্ষে প্রায় সে সময় দেশটির ১০ লাখ নাগরিক মারা গিয়েছিল। ফলে বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে তা বিশ্ব কৃষিতে ডেকে আনতে পারে ওই ধরনের হঠাৎ মহামারি। আর এমন আশঙ্কায় নড়েচড়ে বসেছেন বিজ্ঞানীরা। নেমে পড়েছেন সমাধানের পথের সন্ধানে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বিশ্বব্যাপী পানি সরবরাহে পরিবর্তন আসবে। ছবি: রয়টার্স
বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বিশ্বব্যাপী পানি সরবরাহে পরিবর্তন আসবে। ছবি: রয়টার্স

এমন একজন বিজ্ঞানী সাচকিয়া ভন নেয়েইচ নেদারল্যান্ডসের উথরেক্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদ্ভিদবিজ্ঞানী চেষ্টা চালাচ্ছেন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও ফসলের ওপর এর প্রভাব জানতে। এ জন্য তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটা দল, শুরু করেন অনুসন্ধান। এ জন্য পরীক্ষাগারে কয়েকটি ছোট ছোট কক্ষ তৈরি করেন তিনি। ওই সব কক্ষে বিভিন্ন ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইড দিয়ে বায়ুমণ্ডল তৈরি করেন। এর কয়েকটিতে ১৫০ পিপিএময়ের নিচে, কয়েকটিতে ৪৫০ পিপিএম এবং কয়েকটিতে ৮০০ পিপিএম ওপর ঘনত্বের ওপরে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস দেওয়া হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বায়ুমণ্ডলে বর্তমানে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়ে চলার যে হার তা যদি এভাবেই বজায় থাকে, তাহলে ২০৯০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে ৮০০ পিপিএম ঘনত্বে পৌঁছে যাবে। এরপর ওই সব কক্ষে বপন করা হয় অ্যাবাডক্সিস থ্যালিয়ানার (এক প্রকারের তেলজাতীয় ফসল) বীজ।

কয়েক সপ্তাহ পর ওই ফসলের গাছগুলো সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠার পর বিজ্ঞানী ভন নেয়েইচ সেগুলোর ওপর দুই ধরনের রোগের জীবাণু ছেড়ে দেন। এর কিছু জীবাণু গাছের শেকড়ে ও কিছু জীবাণু গাছের উপরিভাগে আক্রমণ করে। এরপর আরও কয়েক দিন ওই জীবাণুসহ থাকার পর তিনি গাছগুলো নিয়ে গবেষণা চালান। তাঁর ওই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ইউরোপিয়ান জার্নাল আব প্ল্যান্ট প্যাথোজেন নামের সাময়িকীতে।
ওই সাময়িকীর বরাত দিয়ে দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, বাতাসে উচ্চ ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি গাছের গোড়ায় জীবাণুদের জন্য তেমন কোনো প্রভাব তৈরি করে না। কারণ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি মাটিতে তেমন একটা পরিবর্তনের আঁচড় কাটে না। তবে পাতার জীবাণুর ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। গবেষণায় তাঁরা দেখেছেন, ওই জীবাণুদের কয়েকটি উচ্চ ঘনত্বের কার্বন ডাই-অক্সাইড নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। জীবাণুদের এমন শক্তিশালী হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তাঁরা বিবেচনা করছেন গাছের জীবাণু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন হওয়াকে।

রোগজীবাণু প্রতিরোধে গাছেরা দুটি অ্যাসিডের ওপর নির্ভরশীল। একটি স্যালিসিলিক অ্যাসিড ও অন্যটি জ্যাসমোনিক অ্যাসিড। সাধারণভাবে বলতে গেলে, যেসব জীবাণু গাছের জীবন্ত টিস্যু খেয়ে ফেলে, তাদের দমনে স্যালিসিলিক অ্যাসিড উৎপাদন করে। বিপরীতে যেসব জীবাণু গাছের টিস্যু প্রথমে মেরে তারপর খাওয়া শুরু করে, তাদের প্রতিরোধে জ্যাসমোনিক অ্যাসিড তৈরি করে। বিজ্ঞানী ভন নেয়েইচ দেখেছেন কার্বন ডাই–অক্সাইডের উচ্চ হার গাছদের অধিক হারে জ্যাসমোনিক অ্যাসিড উৎপাদনে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে স্যালিসিলিক অ্যাসিডের উৎপাদন কমে যায়। ফলে স্যালিসিলিক অ্যাসিডের কম উপস্থিতিতে ওই ধরনের জীবাণুর আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়। অন্যদিকে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের এই তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছে।

পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে ধানখেত। ছবি: এএফপি
পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে ধানখেত। ছবি: এএফপি

বিজ্ঞানী ভন নেয়েইচের এই গবেষণায় একটি বিষয় প্রমাণিত যে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় উপস্থিতি গাছদের দৈহিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলে। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে গাছদের ওপর যে প্রভাব পড়বে তা বুঝতে কার্বন ডাই-অক্সাইড মাত্র একটা দিকে আলো ফেলে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসবে পানি ব্যবস্থাপনার ধরনে। ভবিষ্যতে ফসল ফলানোয় পানি ব্যবস্থাপনায় কেমন হবে সেটাও অজানা। ফলে একদিকে কার্বন ডাই–অক্সাইডের বৃদ্ধি অন্যদিকে পানি ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বিষয় ফসলকে ভবিষ্যতে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা–ও একেবারে নিশ্চয়তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বর্তমানে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বিভিন্ন পতঙ্গ ও অন্যান্য মাধ্যমে পৃথিবীর এক কোনা থেকে অন্য কোনায় মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তের সঙ্গে সঙ্গে কীটপতঙ্গ প্রজাতির আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কিছু বিজ্ঞানীরা। এসব বিষয় একত্রে ফসলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা তালগোল অবস্থা তৈরি করেছে।

এই তালগোল অবস্থার মধ্যে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বেড়ানোটা সুখের বিষয় নয়। তারপরও বিজ্ঞানীরা কয়েকটি সমাধানের কথা ভাবছেন। এর মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যের প্রজাতিগুলো বিভিন্ন জলবায়ুতে রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হলে কী ধরনের সাড়া দেয়, সে তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলছেন। এবং দ্বিতীয়টি, গাছের যেসব জিন রোগজীবাণু প্রতিরোধ করে সেগুলো চিহ্নিত করে তা উন্নয়নের কথা বলছেন। আর এসব পদ্ধতি অবলম্বনে এক অন্ধকার ভবিষ্যতে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রস্তুত হওয়ার এখন সময়ের দাবি।