৫ ডলারে শুরু হয়েছিল সুমনের কাজ

সুমন সাহা। ছবি: খালেদ সরকার
সুমন সাহা। ছবি: খালেদ সরকার

নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার আলীনগর গ্রামে সুমন সাহার বাড়ি। বাবা হরিপদ চন্দ্র সাহা ও মা পুষ্প রানী সাহা। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সুমন। মাধ্যমিক, চরসিন্দুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, তারপর নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক হন কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলে। 

প্রচলিত চাকরির সুযোগ ছিল সুমনের। তবে সেটি না করে করছেন ফ্রিল্যান্সিং। মাসে তাঁর আয় কমবেশি ৫ থেকে ৬ হাজার ডলার। আউটসোর্সিং কাজ পাওয়ার জায়গা (মার্কেটপ্লেস) আপওয়ার্কে কাজ করেন সফটওয়্যারের মান নিয়ন্ত্রণ, কারিগরি সেবা এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্ট নিয়ে। স্ত্রী সন্ধ্যা রায়ও একজন ফ্রিল্যান্সার হওয়ায় শুরুর দিকে ফ্রিল্যান্সিং করার সময় তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। একমাত্র ছেলে সার্থক সাহাকে নিয়ে তাঁদের ছোট একটা সংসার। 

তবে সুমনের পেছনের গল্পটি ছিল একটু অন্য রকম। তিন বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক টানাটানি ছিল সুমনের পরিবারে। ২০০৮ সালে যখন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগে তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে ছিলেন, তখন কিনতে পারেননি একটি কম্পিউটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব ও বন্ধুদের ল্যাপটপই ছিল সুমনের শেষ ভরসা। তখন মেজো বোনের স্বামী ও বাবা কম্পিউটার কেনার জন্য টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন। সুমন বলেন, ‘এরপর আমি একটা কম্পিউটার কিনি। এমনও সময় গেছে আমার সেমিস্টার শুরু হয়ে গেছে, বই কিনতে পারিনি। স্যারদের দেওয়া নোট ও বন্ধুদের বই থেকে খাতায় নোট করে নিয়ে পড়েছি।’ এভাবেই চলতে থাকে সুমনের জীবন।

পরিবারের কথা ভাবতেন সুমন। ভাবতেন যদি পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়িতে সাহায্য করা যেত! বাবার ছিল একটা মিষ্টির দোকান, তার ওপর বিভিন্ন মানুষের কাছে ধারদেনায় জর্জরিত। ‘বাবা, মা যদিও মুখ ফুটে কিছু বলত না। কিন্তু আমি সব বুঝতাম। আর নিজের ওপর রাগ হতো, কিছুই করতে পারব না। শেষমেশ উদ্যোগ নিলাম সব ছেড়ে দিয়ে বাবার মিষ্টির দোকানটিতেই বাবাকে সহযোগিতা করব।’

২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষের দিকে প্রথম আলো পড়ে সুমন সাহা জানতে পারেন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি চাকরি মেলা হবে। সেখানে একটা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশি করার জন্য সুযোগও পেলেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন সুমন। বললেন, ‘নিজে নিজেই ওডেস্কে (বর্তমান আপওয়ার্কস) অ্যাকাউন্ট খুলি। কিছু বুঝি না, ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে শিখতে লাগলাম। এবার বিড করা শুরু করলাম। কিন্তু কোনো কাজ পাইনি। একটু হতাশ হয়ে গেলাম। ভাবলাম এভাবে হবে না। আগে স্থানীয় বাজারে কাজ করতে হবে। পরে বাইরে। যেখানে শিক্ষানবিশি করতাম, সেখানে চাকরিও হয়ে গেল।’

 ২০১২ সালে আবার মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করলেন সুমন। ৫ ডলারের একটি সফটওয়্যার টেস্টিংয়ের কাজও পেলেন। কাজটি ভালোভাবে করে দেওয়ায় বাইরে খুশি হয়ে আরও তিনটি কাজ দেয় একটু বেশি মূল্যে। এভাবেই চলতে থাকে। ২০১৩ সালের শুরুতে আইপ্যাড অ্যাপ্লিকেশন টেস্টিং কাজের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ৫২ জনের মধ্যে ২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ থেকে সুযোগ পান সুমন। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। 

বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারদের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি বাংলাদেশ আপওয়ার্কস গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবেও আছেন সুমন সাহা। এই পেশায় অনেকে কাজ করতে চান, তিনি তাঁদের সাহায্য করতে চান। নতুনদের উদ্দেশে সুমন সাহা বললেন, ‘আইওএস অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপমেন্টে এসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কিছুটা কম। এসবে চেষ্টা করা ভালো। আর নতুনদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সব সময়। লেগে থাকুন, সাফল্য আসবেই।’