অ্যান্ড্রয়েডের বারোটা বাজাবে হুয়াওয়ে?

নিজেদের তৈরি নতুন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে এসেছে হুয়াওয়ে। বলা হচ্ছে, গুগলের অ্যান্ড্রয়েডের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এই অপারেটিং সিস্টেম। ছবি: রয়টার্স
নিজেদের তৈরি নতুন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে এসেছে হুয়াওয়ে। বলা হচ্ছে, গুগলের অ্যান্ড্রয়েডের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এই অপারেটিং সিস্টেম। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ে। তবে এবার প্রযুক্তিগত দিক থেকেই প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে কোম্পানিটি। নিজেদের তৈরি নতুন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে এসেছে হুয়াওয়ে। বলা হচ্ছে, গুগলের অ্যান্ড্রয়েডের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এই অপারেটিং সিস্টেম। তবে কি অ্যান্ড্রয়েডের বাজার দখল করবে হুয়াওয়ে?

হুয়াওয়ের তৈরি এই নতুন অপারেটিং সিস্টেমের নাম ইংরেজিতে ‘হারমনিওএস’। চীনা ভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘হংমেং’। গত শুক্রবার দক্ষিণ চীনের দংগুয়ান শহরে আয়োজিত হওয়ায় ডেভেলপার কনফারেন্সে আনুষ্ঠানিকভাবে হারমনিওএস-এর পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে হারমনিওএস। এটি মাইক্রোকেরনেল ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম, যা স্মার্ট ওয়াচ থেকে শুরু করে স্মার্ট ফোন, সব ধরনের ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ডিভাইস এবং যানবাহনে ব্যবহৃত সিস্টেমে কাজ করতে পারবে। এমনকি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপেও কাজ করবে হারমনিওএস। চলতি বছরের শেষ নাগাদ হারমনিওএসে চলা স্মার্ট ডিভাইস বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে হুয়াওয়ে

বিশ্বের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের বাজারে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড। এর বাজার অংশীদারত্ব প্রায় ৭৬ শতাংশ। এর পরের অবস্থানেই আছে অ্যাপলের আইওএস। এর বাজার অংশীদারত্ব ২২ শতাংশ। সুতরাং বাজার দখল করতে হলে অবশ্যই গুগল ও অ্যাপলের সঙ্গে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে হুয়াওয়েকে।

হুয়াওয়ের তৈরি নতুন অপারেটিং সিস্টেমের নাম ইংরেজিতে ‘হারমনিওএস’। চীনা ভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘হংমেং’। ছবি: এএফপি
হুয়াওয়ের তৈরি নতুন অপারেটিং সিস্টেমের নাম ইংরেজিতে ‘হারমনিওএস’। চীনা ভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘হংমেং’। ছবি: এএফপি

অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাজিমাত করেছে গুগল। অ্যান্ড্রয়েডের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো—এটি ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। এর ফলে যেকোনো ডেভেলপার সহজে অ্যান্ড্রয়েড নিয়ে কাজ করতে পারেন। হুয়াওয়ের আনা হারমনিওএস তেমনি লিনাক্সভিত্তিক ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। ফলে হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো ডেভেলপার এই অপারেটিং সিস্টেমের বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবেন এবং নতুন প্ল্যাটফর্মের জন্য একে উপযুক্ত করে তোলা যাবে। এরই মধ্যে হুয়াওয়ে হারমনিওএসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অ্যাপ তৈরি করতে ডেভেলপারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

হুয়াওয়ে বলছে, হারমনিওএস তুলনামূলক দ্রুত গতিতে কাজ করবে এবং এটি অত্যন্ত নিরাপদ। তবে এর সঙ্গে অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএসের কোনো মিল নেই। হুয়াওয়ের কনজ্যুমার বিজনেস গ্রুপের প্রধান রিচার্ড ইউ বলছেন, হারমনিওএসের প্রথম সংস্করণ চলতি বছরেই বাজারে আসবে। মূলত স্মার্ট ডিভাইসকে লক্ষ্য করে এই অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। তবে স্মার্টফোনে ব্যবহারের উপযোগী সংস্করণ প্রকাশ করাও অসম্ভব নয়। চাইলে যে কোনো সময় হারমনিওএসের স্মার্টফোন উপযোগী সংস্করণ ব্যবহার করার সক্ষমতা আছে হুয়াওয়ের।

বিশ্বের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের বাজারে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড। এর বাজার অংশীদারত্ব প্রায় ৭৬ শতাংশ। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের বাজারে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড। এর বাজার অংশীদারত্ব প্রায় ৭৬ শতাংশ। ছবি: রয়টার্স

বিশ্লেষকেরা বলছেন, খুব সচেতনভাবেই এখনই নিজেদের অ্যান্ড্রয়েডের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে না হুয়াওয়ে। তবে একই সঙ্গে নিজেদের শক্তিমত্তার জানানও দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্য দিয়ে হুয়াওয়ে একটি বার্তা স্পষ্টভাবেই দিচ্ছে। তা হলো—চাইলেই অ্যান্ড্রয়েডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে হুয়াওয়ে।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ফাইভজি মোবাইল প্রযুক্তির কাজে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে হুয়াওয়ে। বাণিজ্যযুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূল অভিযোগ হলো, হুয়াওয়ে তলে তলে চীনের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য পাচার করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এই কোম্পানিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছে। যদিও হুয়াওয়ে এসব অভিযোগ সব সময়ই অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু বাণিজ্যযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এবং মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তিপণ্য কেনায় বাধা পেয়ে এবার নিজেদের উদ্ভাবন নিয়ে মনোযোগী হয়েছে হুয়াওয়ে। হারমনিওএস নিয়ে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মূল ভাবনা হচ্ছে, যদি মার্কিন কোম্পানি গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম আর ব্যবহার করা না যায়, তবে হারমনিওএস হবে হুয়াওয়ের প্রধান অস্ত্র।

বিশ্বের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের বাজারে অ্যাপলের আইওএসের বাজার অংশীদারত্ব ২২ শতাংশ। এই অপারেটিং সিস্টেমটি ব্যবহার করতে পারেন শুধু আইফোন ব্যবহারকারীরা। ছবি: এএফপি
বিশ্বের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের বাজারে অ্যাপলের আইওএসের বাজার অংশীদারত্ব ২২ শতাংশ। এই অপারেটিং সিস্টেমটি ব্যবহার করতে পারেন শুধু আইফোন ব্যবহারকারীরা। ছবি: এএফপি

জানা গেছে, এরই মধ্যে হুয়াওয়ের সাম্প্রতিক কিছু স্মার্টফোনে হারমনিওএসের কিছু কিছু অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। শিগগিরই ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটি বিশ্বজুড়ে প্রকাশ করা হবে। আবার স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শাওমি, টেনসেন্ট, অপো ও ভিভো নাকি পরীক্ষামূলকভাবে হারমনিওএস ব্যবহার শুরু করেছে। তবে গুগলও বসে নেই। ‘ফিউশা’ নামের নতুন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে গুগল। এটি হবে হারমনিওএসের মতোই। স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ওয়াচ থেকে শুরু করে যে কোনো ইন্টারনেট অব থিংস ডিভাইসে ফিউশা ব্যবহার করা যাবে। অ্যান্ড্রয়েডের মতো ফিউশাও হবে ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। একে বলা হচ্ছে গুগলের নতুন প্রজন্মের অপারেটিং সিস্টেম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুগল ও অ্যাপলের দৌরাত্মে বাজারে হারমনিওএস বিক্রি করা হুয়াওয়ের জন্য বেশ কঠিন হবে। এর আগে স্যামসাং ‘টাইজেন’ নামের অপারেটিং সিস্টেম বাজারে নিয়ে এসেছিল। পরে মাইক্রোসফট নিয়ে আসে উইন্ডোজ মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম। তবে কোনোটিই অ্যান্ড্রয়েড বা আইওএসের কাছে পাত্তা পায়নি। সেই হিসাবে হারমনিওএসের চলার পথও বন্ধুর হবে। বিশেষ করে গুগলের বিভিন্ন জনপ্রিয় সেবায় যদি প্রবেশাধিকার না পাওয়া যায় এবং গুগল প্লে স্টোরের মতো বিপুলসংখ্যক অ্যাপ্লিকেশনের ভান্ডার যদি না থাকে তবে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা খুব কঠিন হবে। স্যামসাং ও মাইক্রোসফটের ব্যর্থতারও মূল কারণ ছিল এগুলো। তবে সেই ভুলের ফাঁদে হুয়াওয়ে পা বাড়াতে চাইছে না। হারমনিওএস-কে ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তৈরি করে শুরুতেই তার ইঙ্গিত দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তা ছাড়া অপারেটিং সিস্টেম তৈরির প্রকল্পে স্যামসাং ও মাইক্রোসফটের চেয়ে বেশি বিনিয়োগও করেছে হুয়াওয়ে।

হুয়াওয়ের আনা হারমনিওএস লিনাক্সভিত্তিক ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। ছবি: এএফপি
হুয়াওয়ের আনা হারমনিওএস লিনাক্সভিত্তিক ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। ছবি: এএফপি

হুয়াওয়ে হয়তো অপেক্ষাকৃত চতুর কৌশল নেওয়ার চেষ্টা করবে। অ্যান্ড্রয়েডের সরাসরি বিরোধিতা না করে শুরুতে স্মার্টফোন বাদে অন্য সব স্মার্ট ডিভাইসে হারমনিওএস ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলবে। একবার জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলে, স্মার্টফোনই আর বাদ থাকবে কেন? তখন অ্যান্ড্রয়েডের একাধিপত্য হুমকিতে পড়তেই পারে। তার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে চীনা প্রতিষ্ঠানটি। হারমনিওএসের স্মার্টফোনে ব্যবহারযোগ্য সংস্করণ তৈরি হয়ে গেলেও, তা রেখে দিয়েছে পকেটে!

তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, ফোর্বস, ডয়চে ভেলে, আইএএনএস ও ওয়্যারড