কীটপতঙ্গের গোপন জীবন ও গোপালচন্দ্র

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য (১ আগস্ট, ১৮৯৫-৮ এপ্রিল, ১৯৮১)। ছবি: সংগৃহীত
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য (১ আগস্ট, ১৮৯৫-৮ এপ্রিল, ১৯৮১)। ছবি: সংগৃহীত

আঠার শিশিতে একটা তেলাপোকা পড়েছে। কী করা যায় সেটা নিয়ে, ভাবছেন গোপালচন্দ্র। রাজ্যের কীটপতঙ্গ নিয়ে তাঁর কারবার। ঘরে যিনি পোকামাকড় পোষেন, তাঁর ঘরে তেলাপোকার বাড়বাড়ন্ত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র তেলাপোকাসহ আঠাগুলো ফেলে দিলেন ঘরের এক কোণে। কিছুক্ষণ পরে দেখেন, একদল লাল বিষপিঁপড়া ভিড় জমিয়েছে আঠার চারপাশে। গোপলচন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করল ব্যাপারটা। দেখলেন, কয়েকটা পিঁপড়া হাবুডুবু খাচ্ছে আঠার ভেতর। আর কয়েকটা আবার দোনোমোনো করছে, কী করবে না-করবে, তা নিয়ে।

বিজ্ঞানী মুচকি হাসলেন পিঁপড়াদের দুর্দশা দেখে। এরপর ভুলে গেলেন তেলাপোকা আর পিঁপড়ার কথা। আধা ঘণ্টা পর আবার মনে পড়ল সে কথা। ফিরে এসে দেখেন, পিঁপড়ারা কোথা থেকে ধুলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা কাঁকর কুড়িয়ে এনেছে। গোপালচন্দ্র বুঝলেন না, কী হতে চলেছে। সুতরাং কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আবার। আড়াই ঘণ্টা পরে ফিরে দেখেন ধুন্ধুমার কাণ্ড! তেলাপোকাটা আর আস্ত নেই। মুখের কাঁকরগুলো আঠার ওপর ফেলে তেলাপোকার কাছে যাওয়ার পথ করে নিয়েছে পিঁপড়াগুলো। তারপর সেই পথ পাড়ি দিয়ে পেয়ে গেছে সাধের খাবার।

তবে আস্ত তেলাপোকা বয়ে নেওয়া খুদে পিঁপড়ার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আঠা শুকিয়ে গেছে। মৃত তেলাপোকার দেহ শক্তভাবে আটকে গেছে মেঝের সঙ্গে। কিন্তু পিঁপড়ারা দমে যায়নি। তাদের প্রত্যেকের মুখে তেলাপোকার দেহকণা। আস্ত তেলাপোকা টেনে নিতে না পেরে পিঁপড়াগুলো ধারালো দাঁড়া ব্যবহার করে টুকরা টুকরা করে কণায় পরিণত করে ফেলেছে ওটাকে। সেই কণাই বয়ে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ার দল।

এ ধরনের ঘটনা কি আমাদের চোখে পড়ে? অথচ সারা বছর চারপাশে পোকামাকড়ের জগতে ঘটে চলেছে বিচিত্র সব ঘটনা। সেসব ঘটনা পাক্কা গবেষকের চোখে সারা জীবন দেখে গেছেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। সেসব কীর্তিকাহিনি লিখে গেছেন ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ নামে তাঁর বিখ্যাত বইয়ে। বিজন পল্লিতে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পিঁপড়াদের কীর্তিকলাপ, পোকামাকড়ের লড়াই দেখতে। প্রজাপতির ডিম থেকে কীভাবে শুঁয়োপোকা হয়, সেই শুঁয়োপোকা কীভাবে খেয়ে খেয়ে নধর হয়, তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে পরিণত হয় মূককীটে, কীভাবে রেশম পোকা তন্তু বোনে—বনবাদাড়ে, মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে সেসব দেখেছেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।

বাংলাদেশে কিংবা গোটা ভারতবর্ষে কীটপতঙ্গ-চর্চার পথিকৃৎ তিনি। জন্মেছিলেন ১৮৯৫ সালের ১ আগস্ট, পূর্ববাংলার তৎকালীন ফরিদপুর জেলার শরীয়তপুরের (বর্তমানে জেলা) লোনসিং গ্রামে। বাবা অম্বিকাচরণ নিতান্ত গরিব মানুষ। গরিব বাবাও সন্তানের বড় আশ্রয়। সেই আশ্রয়টিও হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি। অম্বিকাচরণ ছিলেন পুরোহিত। গান-বাজনা সংস্কৃতিচর্চাও করতেন। তিনি যখন পাঁচ সন্তান রেখে মারা গেলেন, ছেলে গোপালচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। মা শশীবালা অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চেষ্টা করেন। চাষবাস করে, পশুপাখি পুষে কোনো রকমে সংসার চলে। গোপালচন্দ্র মায়ের কাজে সাহায্য করেন, সেই সঙ্গে চলে লেখাপড়া। ১৯১৩ সালে বহু কষ্টে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। পরীক্ষায় তিনি গোটা ফরিদপুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলেন।

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য রচিত ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য রচিত ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত

এরপর তাঁর পক্ষে আর লেখাপড়া চালানো হয়তো অসম্ভব হতো, যদি এক ধনী ব্যক্তি তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিতেন। তাঁরই টাকায় গোপালচন্দ্র ভর্তি হলেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। কিন্তু লেখাপড়া বেশি দিন চালাতে পারলেন না। শিগগিরই বিশ্ব মেতে উঠল প্রথম মহাযুদ্ধে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, মহামারি একসঙ্গে আঘাত হানল দুনিয়াজুড়ে। লেখাপড়াটা তাই আর এগিয়ে নিতে পারেননি। ফিরে আসেন গ্রামে। সেখানে খুব অল্প বেতনে স্কুলে মাস্টারিতে যোগ দেন।

গ্রাম-প্রকৃতির প্রতি গোপালচন্দ্রের দুর্নিবার আকর্ষণ। ঝোপে-ঝাড়ে, বাঁশবনে, মজা পুকুরে, খাল-নদীতে খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির রহস্য। হঠাৎ একদিন জঙ্গলের ভেতরে ‘ওই যে কিসের আলো’ দেখে লোকে ভড়কে গেল। ভয়ে আধমরা। নিশ্চয়ই ভূতপ্রেতের কাজ। রাতদুপুরেই জ্বলে সেই আলো, পাঁচির মায়ের পোড়ো ভিটায়। আলোটা একবার জ্বলে, একবার নেভে। দিনের আলোয় তার টিকিটিও দেখা নেই। মানুষ যখন ভয়ে দিশেহারা, গোপালচন্দ্র তখন নির্বিকার। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে বললেন ওই আলোর রহস্য তিনি ভেদ করবেন। এ জন্য একদিন রাতদুপুরে যাবেন সেই জঙ্গলে। একদিন সত্যি সত্যিই বীরদর্পে ভেদ করতে গেলেন আলোর রহস্য। সঙ্গে এক বন্ধু। বর্ষার রাত। তাই ছাতা, হারিকেন আর একটা ম্যাচ নিয়ে ছুটলেন আলোর পানে। দুই বন্ধু যখন পাঁচির মায়ের ভিটার কাছাকাছি, তখনই জ্বলে উঠল আলোটা। আবার নিভল। আবার জ্বলল। তবুও ভয় পেলেন না দুই বন্ধু। বরং আরও কাছে এগিয়ে গেলেন।

খুব কাছে গিয়ে বুঝলেন, আলোটার উৎস একটা পচা পুরোনো গাছের গুঁড়ি। তার ভেতরে আলোটা জ্বলছে একটানা। জ্বলছে, নিভছে না। আলোটা কিন্তু আগুনের মতো লকলক করে জ্বলছে না। জ্বলছে গরম লোহা কিংবা কয়লার মতো, কোনো শিখা নেই। গোপালচন্দ্র দেখলেন পাশেই একটা কচুগাছ। সেটার একটা পাতা ঝড়ে-বাতাসে দুলে দুলে মাঝেমধ্যে ঢেকে দিচ্ছে আলোটাকে। তাই দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে আলোটা জ্বলছে-নিভছে। কিন্তু আলোটা জ্বলছে কেন? গোপালচন্দ্র বুঝলেন সে রহস্যও। আসলে গাছের গুঁড়ি পচে জমা হয়েছে মিথেন গ্যাস। সেই গ্যাসই বাতাসের সংস্পর্শে এসে জ্বলে ওঠে।

গোপালচন্দ্র পুরো বিষয়টা গুছিয়ে একটা বিজ্ঞানধর্মী প্রবন্ধ লিখলেন। প্রবন্ধটির নাম দিলেন ‘পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণ ক্ষমতা’। প্রবন্ধটা ছাপা হলো ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। আর তাতেই বদলে গেল গোপালচন্দ্রের জীবন। প্রবন্ধটা চোখে পড়েছিল বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্রের। তিনি গোপালচন্দ্রের ঠিকানা জোগাড় করে পাঠিয়ে দিলেন শ্রী পুলিনবিহারীকে, গোপালকে কলকাতায় নিয়ে যেতে।

তত দিনে জগদীশ বসুর নাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। তাঁর সঙ্গে গোপালচন্দ্রের সাক্ষাৎ হলো। হলো দীর্ঘ আলাপ। পাকা জহুরির চোখে জগদীশ বসু যাচাই করলেন গোপলচন্দ্রকে। বুঝলেন এ ছেলের প্রতিভা আছে।

তত দিনে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানেই কাজ করার সুযোগ ঘটল গোপালচন্দ্রের। প্রথম দিকে ছবি তোলা, ইলেকট্রিক কাজকর্মের তালিম দেওয়া হলো তাঁকে। বৈজ্ঞানিক ছবি আঁকা শেখানোর জন্য ভর্তি করা হলো একটা কলেজে। গাছপালা, কীটপতঙ্গ নিয়ে অনেক গবেষণা করলেন। পেপারও লিখলেন। কিন্তু জগদীশ বসুর সেগুলো পছন্দ হলো না। একদিন একটা মাকড়সার মাছ শিকারের ছবি তুলে ফেললেন। সেই ছবি জগদীশ চন্দ্র খুব পছন্দ করলেন। উৎসাহ আরও বেড়ে গেল গোপালচন্দ্রের। তার মাস ছয়েক পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্স গবেষণা করতে এলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে। তাঁর সহকারী হলেন গোপালচন্দ্র।

এরপর কীটপতঙ্গ নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা করেছেন। পিঁপড়াদের লড়াই দেখেছেন, তাদের সামাজিক জীবন দেখেছেন, দেখেছেন শুঁয়োপোকার পিঠের ভেতর কীভাবে বোলতারা ডিম পেড়ে দেয়, সে দৃশ্যও। নিজের বাড়িটাকেই বানিয়েছিলেন পোকামাকড়ের চিড়িয়াখানা। বোতলের ভেতর পোকামাকড় পুষতেন, তাদের খাবারদাবার বাসস্থানের ব্যবস্থাও করতেন নিজ হাতে। পোকামাকড়ের বিচিত্র মজার জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ নামে একটা বৈজ্ঞানিক বই। এই বইয়ের জন্যই তিনি পেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্মানজনক রবীন্দ্র পুরস্কার।

গোপালচন্দ্র আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সঙ্গে মিলে গড়েছিলেন ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ নামের একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সম্পাদক হয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের ম্যাগাজিন ‘বিজ্ঞানকে জানো’র। ১৯৫১ সালে প্যারিসে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন বসে। সেখানে গোপালচন্দ্র আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ভারতীয় কীটপতঙ্গ নিয়ে আলোচনার জন্য। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার অজুহাত তুলে তাঁকে শেষমেষ সেই সম্মেলন থেকে বাদ দেওয়া হয়। তবে ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্সে ভূষিত করে। সে বছরের ৮ এপ্রিল প্রকৃতির মহান সাধক শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

১ আগস্ট ছিল গোপালচন্দ্রের ১২৫তম জন্মদিন। বিস্মৃত এই বিজ্ঞানীকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

সূত্র
১. ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং
২. ‘গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য’, এম এ আজিজ মিয়া, ঢাকা, বাংলা একাডেমি
৩. ‘গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য’: ব্যক্তি ও বিজ্ঞানী, গৌরী মিত্র, কলকাতা, গাঙচিল

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা, প্রথম আলো