তাঁরা যখন অনলাইনে

ইনস্টাগ্রামে মেয়ে অ্যাপল মার্টিনের সঙ্গে মার্কিন অভিনেত্রী গিনেথ প্যালট্রোর েসই ছবি (ওপরে), যেটিতে আপত্তি জানিয়ে মন্তব্য করেছিল তাঁর মেয়ে
ইনস্টাগ্রামে মেয়ে অ্যাপল মার্টিনের সঙ্গে মার্কিন অভিনেত্রী গিনেথ প্যালট্রোর েসই ছবি (ওপরে), যেটিতে আপত্তি জানিয়ে মন্তব্য করেছিল তাঁর মেয়ে
>সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়োজ্যেষ্ঠদের বিচরণ বাড়ছে। এই বিচরণক্ষেত্রগুলো তাঁদের কাছে একেবারেই নতুন। তাঁদের চলাফেরা যে সবার সামনে উন্মুক্ত, তা অনেকেই ভুলে যান। এমন কিছু শেয়ার করে বসেন, যা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হয় ক্ষুণ্ন। সন্তান হিসেবে তাঁদের ভার্চ্যুয়াল জীবনের আদবকেতা শেখানোর দায়িত্ব আপনারই, কারণ এ জগতে নতুন প্রজন্মের অভিজ্ঞতা বেশি। তাই অনলাইনে বয়োজ্যেষ্ঠদের বেমানান আচরণ বদলানোর কিছু পরামর্শ জেনে নিন এবার।

সুফিয়া কামালের একটি ছড়া ছিল পাঠ্যবইয়ে। নাম ‘আজিকার শিশু’। ছড়ার প্রথম চারটি লাইন এ রকম—‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/ তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।/ আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/ তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।’

সুফিয়া কামাল যে বয়সে ঘুড়ি ওড়াতেন, সে বয়সে তাঁর আমলের শিশুরা কলের জাহাজ ওড়াত। আর হাল আমলের ‘আজিকার শিশু’রা কী করছে? বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। এই তো কদিন আগে, আট মাস বয়সী বন্ধুকন্যা কোলে আসতেই স্মার্টফোনটি দখল করে বসল। দখল করেই ছোট পুতুল পুতুল আঙুল দিয়ে পর্দায় ‘সোয়াইপ’ করতে শুরু করে দিল! মানে সে জানে সোয়াইপ করলেই স্মার্টফোনের ঘুম ভাঙবে। হলফ করে বলতে পারি, এমন অভিজ্ঞতা আপনারও প্রতিনিয়ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার এক গবেষণার ফলে দেখা যাচ্ছে, এখনকার ৯০ শতাংশ শিশুই স্মার্টফোন ও ট্যাব ব্যবহারে পটু। আর ৩–৪ বছর হতে না–হতেই একেকজন রীতিমতো স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। কারণ, প্রতি ১০ জন মা–বাবার মধ্যে ৭ জনই সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন।

এই লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়োজ্যেষ্ঠদের বিচরণ নিয়ে। শিশুদের টেনে আনতে হলো তুলনার উদ্দেশ্যে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সুফিয়া কামালের ছড়া দিয়ে লেখা শুরু করার বিষয়টি আপনার কাছে পরিষ্কার। হ্যাঁ, এটা মানতেই হবে—বয়োজ্যেষ্ঠদের তুলনায় আজকালকার দুগ্ধপোষ্য শিশুরা বেশি যন্ত্রবান্ধব। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গেমস বা অনলাইন সংস্কৃতি ওদের ভেতরেই থাকে, প্রযুক্তির ভাষায় যাকে বলে ‘বিল্ট-ইন’। এ ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠরাই বরং দুগ্ধপোষ্য শিশু। তবে ভার্চ্যুয়াল জগতের হাতছানিতে তাঁরা সাড়া দিতেও ভুলছেন না। একটু খেয়াল করে দেখুন, আজকাল মা–বাবা–চাচা–চাচি তো বটেই, দাদা–দাদিরাও ফেসবুকে বিচরণ করছেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ডিজিটাল মার্কেটিং গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমার্কেটার এক গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ফেসবুকে বয়োজ্যেষ্ঠদের আনাগোনা বাড়ছে মোটা দাগে। তরুণেরা নয়, ৫৫ বছরের বেশি বয়সীরাই মূলত এখন ফেসবুকের বড় জনগোষ্ঠী।

আরেকটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। ভুক্তভোগী এক বন্ধু। তাঁর বাবার বয়স ৫০ পেরিয়েছে। নিজে নিজে চেষ্টাচরিত্র করে ফেসবুকে ঢুকেছেন। ‘ফ্রেন্ড’ বানিয়েছেন সন্তান ও সন্তানের বন্ধুদের। দুদিন যেতে না–যেতেই ভুক্তভোগী বন্ধু খেয়াল করল, ফেসবুকের টাইমলাইন তাঁর বাবা এমন একটি লিংক শেয়ার করেছেন, যাতে লজ্জায় নাক কাটা যাওয়ার অবস্থা। এ তো বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ব্যাপারস্যাপার। আবার অনলাইনে বয়োজ্যেষ্ঠদের ছোটখাটো কিছু ব্যাপারও কম বিড়ম্বনার নয়। কোন খবরটি ভুয়া, কোন সংবাদমাধ্যম অবিশ্বস্ত—বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকেই তা খেয়াল করেন না। ফলে ভুয়া খবর ছড়ানোর ব্যাপারেও তাঁরা বেশ এগিয়ে। কম যান না বিভ্রান্তিকর তথ্য বা ছবি শেয়ারের বেলাতেও। অনলাইনে কিছু দেখলেই বেদবাক্য বলে ধরে নেন তাঁরা। আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা? তাঁরা যে ভরা হাটে বসে ঘরের কথা বলছেন, তা বেমালুম ভুলে বসে থাকেন। বিশেষ করে পুরোনো কিংবা সন্তানদের ছবি শেয়ারের বেলাতেই ঘটে যায় যত কাণ্ড।

এমন এক কাণ্ডের জন্ম দিয়েছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী গিনেথ প্যালট্রো। এ বছরের মার্চ মাসের কথা। ইনস্টাগ্রামে মেয়ে অ্যাপল মার্টিনের সঙ্গে তোলা এক ছবি শেয়ার করেছিলেন গিনেথ। নিচে অ্যাপলের কমেন্ট ছিল, ‘মা, আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমার সম্মতি ছাড়া তুমি কিছু প্রকাশ করতে পারো না।’ কী একটা অবস্থা!

বিশেষজ্ঞ যা বলেন—

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার দিয়েছেন পরামর্শ।

l ছেলেবেলায় মা–বাবা আমাদের হাঁটতে শেখান। তাঁরা জানেন, পথটা কেমন আর কী করে হাঁটতে হয়। ঠিক উল্টোটাই ঘটে ভার্চ্যুয়াল জগতে, মা–বাবা এই দুনিয়ায় নবীন। তাই আপনি তাঁদের হাত ধরে হাঁটতে শেখান। তাঁরা চাইলে আপনি নিজে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা টুইটারে অ্যাকাউন্ট খুলে দিন।

l সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মা–বাবা বিব্রতকর কিছু শেয়ার না করলে কোনো সমস্যাই নেই। তেমন কিছু হলে কথার ছলে প্রসঙ্গটি তুলুন। সরাসরি শেখানোর মতো করে নয়, উদাহরণ দিয়ে বা কৌশলে বিষয়টি বোঝাতে হবে।

l মা–বাবা ফেসবুকের কোন পেজে লাইক দেবেন, ইনস্টাগ্রামে কাকে ফলো করবেন—তা আপনি ঠিক করে দিতে পারেন না। তবে বিতর্কিত কোনো পেজে লাইক দেওয়া থাকলে তাঁদের ওয়ালে পোস্ট ভেসে আসবে। মা–বাবা সেসব শেয়ারও হয়তো করে বসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনি বিতর্কিত পেজগুলো আনফলো করার ব্যাপারে অনুরোধ করতে পারেন।

l এ ছাড়া কোন পেজে লাইক দেওয়া যায়, কোন গ্রুপে যুক্ত হলে ভালো—এরকম আলোচনাও কাজে আসবে। মা–বাবাকে বোঝাতে হবে, কোনো পেজে লাইক দেওয়ার আগে কিছুটা সময় নিতে হবে। পেজটিতে কী ধরনের কনটেন্ট থাকে, বিশ্বাসযোগ্য কি না—এসব দেখেশুনে তারপরই লাইক দেওয়া উচিত।

l ভার্চ্যুয়াল জগতে যে সবকিছুই উন্মুক্ত, তা মা–বাবাদের জানাতে হবে। এই জগতে একান্ত বিষয়আশয় খোলাসা না করাই উত্তম। ছবি শেয়ারের বেলাতেও খুব সতর্ক থাকা চাই। কোন ছবি শেয়ার করা যাবে, কোনটি যাবে না—তা মা–বাবাকে জানিয়ে রাখুন স্পষ্ট করে। বিশেষ করে শিশুদের ছবি শেয়ার করার ব্যাপারে সতর্কতা খুব জরুরি। আর কোনো অনুষ্ঠানে ছবি তোলার পর সবার সম্মতি নিয়েই প্রকাশ করা ভদ্রোচিত। কারণ, সেখানে অপরিচিত বা কম পরিচিত মানুষও থাকতে পারেন।

l অনেক বয়োজ্যেষ্ঠই অনলাইনে কোনো খবর দেখলে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে বসেন। তাঁদের বোঝাতে হবে, সব সংবাদমাধ্যম বিশ্বাসের পাত্র নয়। বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইটগুলোর একটি তালিকা করে দিতে পারেন। আর কিছু শেয়ার করার আগে তথ্য যাচাইয়ের জন্য তো গুগল আছেই। গুগলেও যে ঝামেলা নেই, তা তো নয়। তবে গুগল করে কোন ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্বাস করা যায়, তারও তালিকা করে দিতে পারেন।