নতুন ওয়াই-ফাই গতিতে ছাড়িয়ে যাবে সবাইকে

ওয়্যারলেস সংযোগের দুনিয়ায় সবচেয়ে হালনাগাদ প্রযুক্তি হলো ‘ওয়াই-ফাই সিক্স’। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তির উদ্বোধন হয়নি। তবে হাতেখড়ি হয়ে গেছে। ছবি: এএফপি
ওয়্যারলেস সংযোগের দুনিয়ায় সবচেয়ে হালনাগাদ প্রযুক্তি হলো ‘ওয়াই-ফাই সিক্স’। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তির উদ্বোধন হয়নি। তবে হাতেখড়ি হয়ে গেছে। ছবি: এএফপি

প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তি বিশ্ব। চমকে দিচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবন। ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের অপর নাম গতি। এরই মধ্যে দ্রুত গতির ফাইভ জি প্রযুক্তি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এই গতির সুবিধা ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনের পর্দায় পৌঁছে দিতে এবার আসছে নতুন ওয়াই-ফাই, যার পোশাকি নাম ‘ওয়াই-ফাই সিক্স’।

ওয়্যারলেস সংযোগের দুনিয়ায় সবচেয়ে হালনাগাদ প্রযুক্তি হলো ‘ওয়াই-ফাই সিক্স’। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তির উদ্বোধন হয়নি। তবে হাতেখড়ি হয়ে গেছে। অর্থাৎ চালু করার আগে একটি নতুন ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে যতগুলো ধাপ আছে সবই পার হয়ে গেছে ওয়াই-ফাই সিক্স। এই প্রযুক্তি সমর্থন করার মতো নেটওয়ার্কিং হার্ডওয়্যার তৈরি হয়ে গেছে। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থন করতে পারে এমন পণ্য উৎপাদনও শুরু করে দিয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইন্টারনেটের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ওয়াই-ফাই সিক্স। বর্তমানে চলছে ওয়াই-ফাই ফাইভ। এর তুলনায় ওয়াই-ফাই সিক্সে গতি বাড়বে প্রায় তিনগুণ। একই সঙ্গে একাধিক ব্যবহারকারীকে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে দিতে পারবে ওয়াই-ফাই সিক্স। এতে যুক্ত হয়েছে হালনাগাদ নিরাপত্তা প্রযুক্তি। সারা বিশ্বেই এখন মোবাইল গ্যাজেট, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ডিভাইস ও ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার পর যদি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য ওয়াই-ফাই সিক্সে সমর্থনযোগ্য করে তোলা শুরু করে, তবেই শুরু হয়ে যাবে ওয়াই-ফাই সিক্স প্রজন্ম।

ইন্টারনেটের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ওয়াই-ফাই সিক্স। বর্তমানে চলছে ওয়াই-ফাই ফাইভ। এর তুলনায় ওয়াই-ফাই সিক্সে গতি বাড়বে প্রায় তিনগুণ। ছবি: সংগৃহীত
ইন্টারনেটের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ওয়াই-ফাই সিক্স। বর্তমানে চলছে ওয়াই-ফাই ফাইভ। এর তুলনায় ওয়াই-ফাই সিক্সে গতি বাড়বে প্রায় তিনগুণ। ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে এল ওয়াই-ফাই সিক্স
ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির মান নির্ধারণ করে থাকে ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইইই) নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি সমর্থিত ডিভাইসগুলোকে সার্টিফিকেট দেয় বা সঠিক মান নিশ্চিত হলে প্রত্যয়ন করে ‘ওয়াই-ফাই অ্যালায়েন্স’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের প্রায় আট শরও বেশি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ওয়াই-ফাই অ্যালায়েন্স। এতে আছে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, ইন্টেল, কোয়ালকম, ব্রডকম, স্যামসাং, এলজি ইলেকট্রনিকসের মতো বাঘা বাঘা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।

প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন রেডিও প্রযুক্তি নিয়ে আসার কাজটি করে এই দুই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। অর্থাৎ, ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি হালনাগাদের কাজটিও হয় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর। ২০১৪ সালে নিয়ে আসা হয়েছিল ওয়াই-ফাই ফাইভ। এর অপর নাম ‘আইইইই ৮০২.১১ এসি’। এখনকার প্রায় সব স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা আইওটি ডিভাইসে সাধারণত ওয়াই-ফাই ফাইভ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেই ধারাবাহিকতাতেই নিয়ে আসা হচ্ছে ওয়াই-ফাই সিক্স বা ‘আইইইই ৮০২.১১ এএক্স’।

ওয়াই-ফাই সিক্সে কী আছে?
নতুন ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির বড় চমক হচ্ছে গতি। এখনকার ওয়াই-ফাই ফাইভে সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ৩ দশমিক ৫ জিবিপিএস (গিগাবিটস পার সেকেন্ড)। ওয়াই-ফাই সিক্সে এটি হবে প্রায় ৯ দশমিক ৬ জিবিপিএস। সাধারণত একটি ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে যখন একাধিক ডিভাইস যুক্ত হয়, তখন ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। কিন্তু ওয়াই-ফাই সিক্সে তা হবে না। বরং একাধিক ব্যবহারকারীকে একই মানের ইন্টারনেট সেবা ও তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করবে এই নতুন প্রযুক্তি। বর্তমানের তুলনায় তথ্য আদান-প্রদানের গতি বেড়ে যাবে প্রায় চার গুণ।

নতুন ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির বড় চমক হচ্ছে গতি। এখনকার ওয়াই-ফাই ফাইভে সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ৩ দশমিক ৫ জিবিপিএস (গিগাবিটস পার সেকেন্ড)। ওয়াই-ফাই সিক্সে এটি হবে প্রায় ৯ দশমিক ৬ জিবিপিএস। ছবি: ওয়াই-ফাই অ্যালায়েন্সের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
নতুন ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির বড় চমক হচ্ছে গতি। এখনকার ওয়াই-ফাই ফাইভে সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ৩ দশমিক ৫ জিবিপিএস (গিগাবিটস পার সেকেন্ড)। ওয়াই-ফাই সিক্সে এটি হবে প্রায় ৯ দশমিক ৬ জিবিপিএস। ছবি: ওয়াই-ফাই অ্যালায়েন্সের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, ওয়াই-ফাই সিক্স দুই ধরনের ফ্রিকোয়েন্সিতে চলতে পারবে। এগুলো হলো ২ দশমিক ৪ গিগাহার্টজ ও ৫ গিগাহার্টজ ব্যান্ড। এতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। যোগ করা হয়েছে নতুন নিরাপত্তা মান ‘ডব্লিউপিএথ্রি’। ওয়াই-ফাই ফাইভেও এই নিরাপত্তা মান আছে, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। ওয়াই-ফাই সিক্সে ‘ডব্লিউপিএথ্রি’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে ব্যবহারকারীরা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এনক্রিপশন সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন। এ ছাড়া হ্যাকারদের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে ‘ডব্লিউপিএথ্রি’।

এই নতুন প্রযুক্তি ইন্টারনেটে যুক্ত ডিভাইসের ব্যাটারির কর্মক্ষমতাও বাড়াবে। এতে করে দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট ব্যবহারেও ডিভাইসের ব্যাটারি শেষ হবে না। ডিভাইস চলবে দীর্ঘক্ষণ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওয়াই-ফাই সিক্সে স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন আইওটি ডিভাইসে স্বস্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে। বিশেষ করে জনবহুল স্থানে এটি হবে একমাত্র বিকল্প। একই ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে থেকেও একজন ব্যবহারকারী যেমন নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখতে পারবে, তেমনি ওই একই সময়ে আরেক ব্যবহারকারী অনলাইনে কোনো বাধা ছাড়াই খেলতে পারবে গেম, আবার আরেকজন কোনো বাফারিং ছাড়াই করতে পারবেন ভিডিও চ্যাটিং।

ওয়াই-ফাই সিক্সে স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন আইওটি ডিভাইসে স্বস্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে। বিশেষ করে জনবহুল স্থানে এটি হবে একমাত্র বিকল্প। ছবি: রয়টার্স
ওয়াই-ফাই সিক্সে স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন আইওটি ডিভাইসে স্বস্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে। বিশেষ করে জনবহুল স্থানে এটি হবে একমাত্র বিকল্প। ছবি: রয়টার্স

ভবিষ্যৎ সিক্সেই?
ওয়াই-ফাই সিক্স আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার আগেই এই প্রযুক্তি সমর্থন করে এমন রাউটার, স্মার্টফোন, চিপসেট তৈরি করা শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি স্যামসাং নিয়ে এসেছে নতুন স্মার্টফোন ‘গ্যালাক্সি এস১০’, যা ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থন করবে। ওদিকে আসুস, নেটগিয়ার, টিপি-লিংক বাজারে এনেছে ওয়াই-ফাই সিক্স রাউটার। এইচপি ও ডেল এনেছে ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থন করা নতুন ল্যাপটপ। আর কোয়ালকম এনে ফেলেছে ওয়াই-ফাই সিক্সে কাজ করতে পারবে এমন প্রসেসর। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রযুক্তি বিশ্ব নতুন প্রজন্মের ওয়াই-ফাই সিক্সকে বরণ করে নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত।

ধারণা করা হচ্ছে, আসছে শরতেই ওয়াই-ফাই সিক্স চালুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে শুরুতেই সব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারী ঝাঁপিয়ে পড়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করবে, তা ভাবা ভুল হবে। কারণ ওয়াই-ফাই সিক্স ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেটের পুরো নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থাতেই পরিবর্তন আনতে হবে। বদলাতে হবে সংশ্লিষ্ট হার্ডওয়্যার। এর জন্য ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থিত রাউটার ব্যবহার করাও বাধ্যতামূলক। আবার আইওটি ডিভাইসগুলোকেও এই প্রযুক্তির উপযোগী হতে হবে। এটি পুরোনো ডিভাইসে সম্ভব নয়, কারণ এর জন্য হার্ডওয়্যারে পরিবর্তন প্রয়োজন।

আবার, ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থিত রাউটার, প্রসেসর ও আইওটি ডিভাইসগুলোও শুরুতে বেশ ব্যয়বহুল হবে। বর্তমানে যেসব রাউটার বা ডিভাইস ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থন করছে, সেগুলোর দাম বাকিদের তুলনায় বেশি। যেমন: স্যামসাং যে ফোনে ওয়াই-ফাই সিক্স সমর্থনের সুবিধা এনেছে, সেটি হাই-এন্ডের স্মার্টফোন। সুতরাং শুরুতে কড়ি ফেললেই মিলবে বেশি সুবিধা।

অর্থাৎ, ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির দুনিয়ায় পরিবর্তন আসবে ধীরে-সুস্থে। কিন্তু তা হবে সর্বগ্রাসী। ইন্টারনেটে দ্রুত গতি কে না চায়? আর এই প্রবণতাই ব্যবহারকারীদের টেনে আনবে ওয়াই-ফাই সিক্সে।

তথ্যসূত্র: ওয়্যারড, সিনেট ও দ্য ভার্জ