ওই আসে খুনি রোবট!

রোবট সৈনিকের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সজাগ করছেন সুস্থ চিন্তার মানুষ। ছবি: রয়টার্স
রোবট সৈনিকের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সজাগ করছেন সুস্থ চিন্তার মানুষ। ছবি: রয়টার্স

রোবট মানুষের নানা উপকার করে আসছে। মানুষের আবিষ্কারের এই পরিশ্রমী যন্ত্র আজকাল কেবল কল-কারখানা নয়, একই সঙ্গে হাসপাতাল, বৃদ্ধদের সেবাকেন্দ্র, এমনকি মানুষের বসতবাড়িতেও জায়গা করে নিচ্ছে। এরা কেউ বৃদ্ধ রোগীর দিকে ঠিক সময়ে এগিয়ে দিচ্ছে ওষুধ। কেউ আবার ভারী কোনো বস্তু অনায়াসে বহন করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছে। কেউ আবার নীরবে করছে ঘর পরিষ্কারের কাজ। ফলে রোবট হচ্ছে মানুষের বন্ধু, যে বন্ধু মানুষের নানা রকম উপকার করছে কোনো রকম প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই। সম্ভবত এ কারণেই রোবটের প্রতি আমাদের উৎসাহ ও আসক্তি দিন দিন বাড়ছে।

তবে কেবল আমাদের মতো সাধারণ মানুষজনই যে রোবট নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছে, তা কিন্তু নয়। পর্দার আড়ালে সামরিক উর্দিধারীরা অনেক দিন থেকেই রোবট নিয়ে উৎসাহ দেখিয়ে আসছে। তারা নিজেদের গণ্ডি, অর্থাৎ যুদ্ধবিগ্রহ, সেই কাজে কীভাবে রোবট কাজে লাগিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করা যায়, তা নিয়ে সেই শুরুর দিন থেকেই গভীর চিন্তাভাবনা করছে। কেন, সহজে তা বোঝাতে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা দরকার। আসুন, এ রকম একটি দৃশ্য শুরুতে আমরা কল্পনার পর্দায় এঁকে নিই।

দখলদার এক সেনাবাহিনী বেশ বড় আকারের একটি শহর অবরোধ করে রাখলেও শহরের দখল নিতে পারছে না। শহর কবজায় আনতে হলে সৈন্যদের সেখানে পাঠাতে হয়। যারা কিনা ঘরে ঘরে ঢুকে যুদ্ধ চালিয়ে শত্রুকে বধ করার প্রক্রিয়ায় নিজেদের জীবনও বিপন্ন করে তুলতে পারে। আর রক্ত-মাংসের মানুষের বদলে যদি নিজে থেকে চিন্তাভাবনা করে অস্ত্র চালাতে সক্ষম রোবট সেখানে পাঠানো যায়, তবে দ্বিতীয় আশঙ্কাটি সহজেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ নিজের দলের সৈনিকের মৃত্যুর মতো ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হবে তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ঝামেলাও এড়িয়ে যাওয়া। রোবট এখানে নির্ভয়ে এগিয়ে যাবে শত্রুর একেবারে বাড়ির অন্দরমহলে। এতে আগে থেকে কৃত্রিম মেধা সংযুক্ত থাকায় সেই মেধার সহায়তায় কী করতে হবে, তা তাকে বলে দেওয়া থাকে। ফলে রোবট খুব সহজেই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে শহর ঝুঁকিমুক্ত করে তুলবে। এবং তার পরেই কেবল শত্রুমুক্ত হওয়া সেই পথ ধরে চলে আসবে মনুষ্য যোদ্ধারা।

সামরিক লাভ-ক্ষতির হিসাব এখানে খুব সহজ হওয়ায় সমরনায়কদের নজরও যুদ্ধে ব্যবহারের রোবটের দিকে আকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে রোবট সৈনিকের ভয়ংকর যে দিক, সেটা নিয়ে তারা তেমন চিন্তিত নয়। ভয়ংকর সেই দিকটি নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আগামীর জন্য যেটা ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আসতে পারে। কৃত্রিম মেধার সাহায্য নিয়ে প্রোগ্রামিং করে নেওয়া রোবটকে শত্রু চিনে নেওয়ার জন্য কিছু ধারণা শিখিয়ে দেওয়া হবে। যেমন অস্ত্র হাতে থাকা যেকোনো মানুষকে দেখলে দ্বিধা না করে, সেই ব্যক্তিকে বধ করা। কিংবা গায়ের রঙের ভিত্তিতে বিশেষ কোনো জাতিসত্তার মানুষকে চিনে বধ করা।

এ রকম বর্ণনা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসা মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু সেই গবেষণা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে, যা গত কয়েক বছর থেকেই সুস্থ চিন্তার মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। আর এ কারণেই আগামীর যন্ত্রদানবের যত্রতত্র বিস্তার বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান তারা মানুষের প্রতি জানিয়ে আসছে।

বিজ্ঞানীরা এসব যন্ত্রের নামকরণ ‘প্রাণঘাতী স্বচালিত অস্ত্র’ করলেও ‘খুনি রোবট’ হিসেবেই এগুলো অনেক বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে। গবেষণা এখন কত দূর এগিয়ে গেছে, সে বিষয়ে পরিষ্কার জানা যায়নি। তবে সামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাকে লক্ষ্যবস্তু ধরে নিয়ে খুন করতে হবে, সে রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম রোবট তৈরি করা প্রযুক্তিগত দিক থেকে তেমন কঠিন কাজ নয়। তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সংঘাতের ময়দানে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলে তারা নিজেরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

এখানে কিন্তু দ্বিতীয় একটি বিপজ্জনক আশঙ্কার দেখা আমরা পাচ্ছি। সেটা হলো—যেহেতু তারা স্বচালিত ও নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম, সে রকম অবস্থায় ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ বা গণহত্যা হলে তার জন্য কাকে দায়ী করা যাবে, তা পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া খুনি রোবট যে নির্বিচার গণহত্যায় লিপ্ত হবে না, নিশ্চিতভাবে তা বলার কোনো উপায় নেই। মানব সৈনিকের বেলায় সহজাত দয়া ও অনুরাগের মতো গুণাবলি দেখার সম্ভাবনা থাকে। এই গুণ মানব সৈনিককে বেপরোয়া আচরণ থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম। কিন্তু রোবটের বেলায় সেটা সম্ভব কি? যন্ত্র তো সে রকম গুণাবলির বাইরে। ফলে দয়া বা অনুকম্পা দেখানো তার পক্ষে এ কারণে সম্ভব নয় যে সে রকম ভাবনার প্রোগ্রামিং যন্ত্রের উৎপাদকেরা তাতে ঢুকিয়ে দেননি। এবং ভবিষ্যতেও যে ঢুকিয়ে দেবেন না, তা তো প্রায় নিশ্চিত। কেননা, খুনি রোবট মোতায়েনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শত্রুকে নির্মূল করা, শত্রুর প্রতি অনুকম্পা দেখানো নয়।

ড্রোন হামলায় অনেক নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
ড্রোন হামলায় অনেক নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

এবারে দেখা যাক সে রকম রোবট তৈরির প্রক্রিয়ায় আমাদের এই পৃথিবী এখন কোন পর্যায়ে আছে এবং কারাই-বা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বিশ্বের যেকোনো দেশে প্রতিরক্ষা খাত সরকারি অর্থ খরচ হওয়ার সবচেয়ে বড় এক মাধ্যম। ফলে এই খাতে বেসরকারি পর্যায়ের ঠিকাদারদের আনাগোনাও সবচেয়ে বেশি। বাইরে থেকে সাহেবি পোশাকে এদের দেখা গেলেও সহজ কথায় এরা হচ্ছে মানুষ মারার কারবারি। ফলে নৈতিকতার ঘাটতিও এই খাতে সহজেই দৃশ্যমান।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয় যেহেতু সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি, ফলে প্রতিরক্ষা ঠিকাদারেরাও পেন্টাগনে যথেষ্ট প্রভাবশালী লবি হিসেবে বিবেচিত। আয়ের নতুন উৎসের ঘ্রাণ আঁচ করতে পেরে এরা সবাই এখন আগামী প্রজন্মের যন্ত্র তৈরি করে তার কার্যকারিতা দেখিয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। বোয়িং ও লকহিড মার্টিনের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবসায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিমান নির্মাতারা মানুষের জড়িত না থাকা অস্ত্র নির্মাণের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে। যে ড্রোন দিয়ে যুদ্ধে মানুষের সরাসরি জড়িত থাকার মতো বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেটাকে তারা এখন কৃত্রিম মেধার সহায়তায় আরও বেশি আধুনিক করে নিয়ে চালক হিসেবে দূরে কোথাও মানুষের উপস্থিতির মতো পরোক্ষ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। ফলে স্বচালিত অস্ত্রের আওতাভুক্ত ড্রোনে এখন আর মনে অনুকম্পা কিংবা অনুরাগ দেখা দেওয়ার মতো ‘ক্ষতিকর’ মানব গুণাবলি নিয়ে সমরনায়কদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি ক্ষেপণাস্ত্রও আজকাল নিজে থেকে লক্ষ্যবস্তু বেছে নিতে পারার মতো উপযোগী হয়ে উঠেছে।

স্বচালিত অস্ত্র নির্মাণ যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলছে, তা নয়। রাশিয়াও এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। খোলা মাঠের যোদ্ধা থেকে শুরু করে মেশিনগান, ট্যাংক—সবই আজকাল যতটা সম্ভব মানব নিয়ন্ত্রণে প্রভাবিত হওয়ার বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে নতুন এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে বিশ্ববাসীকে সজাগ করে তোলার মধ্যে দিয়ে এতে লাগাম টানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও কিন্তু খুব বেশি পিছিয়ে নেই।

মারাত্মক এই ঝুঁকি থেকে বিশ্বকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত বিভিন্ন সংগঠন বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা খুনি রোবট তৈরির এই অশুভ প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট এগিয়ে থাকা হিসেবে যে ছয়টি দেশকে চিহ্নিত করেছে, সেই ছয়টি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ কোরিয়া। সবাই এরা নিজেদের প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করে নেওয়ার কারণ দেখিয়ে খুনি রোবট তৈরি করা এবং সে রকম গবেষণা চালিয়ে যাওয়ায় ব্যস্ত। তবে অন্যদিকে আবার বিশ্বের বিবেকবান মানুষ কিন্তু নতুন এই ভয়াবহ সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সজাগ করে তোলায় লিপ্ত আছেন এবং এদের সেই প্রচেষ্টার কল্যাণেই বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়ে সমাধানের পথ কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায় সেই পথে ধীরে হলেও অগ্রসর হচ্ছে।

খুনি রোবট নিয়ে চলা আলোচনার এই দিকটির কথাই কিছুদিন আগে টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছেন বেসরকারি পর্যায়ের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘ক্যাম্পেইন টু স্টপ কিলার রোবট’ নামের প্রচার অভিযানের মূল সমন্বয়কারী মেরি ওয়ারহ্যাম। তিনি উল্লেখ করেছেন যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবস্থার ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে আরোপ করা যায়, বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশ এখন তা নিয়ে চলা আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। এ ছাড়া ২৯টি দেশ ইতিমধ্যে এ রকম অস্ত্র সার্বিকভাবে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জাতিসংঘের মাধ্যমে জানিয়েছে এবং আরও অনেক দেশ যে ভবিষ্যতে সেই দলে যোগ দেবে, সে বিষয়ে তিনি আশাবাদী। তবে তা নিশ্চিত করে নিতে হলে আগামীর বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করে তোলার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা দরকার এবং সেই উদ্দেশ্যেই জাপান সফরে তাঁর আসা।

পরমাণু অস্ত্র ও প্রাণঘাতী ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের বিরুদ্ধে জাপান সব সময় বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করলেও খুনি রোবট নিয়ে দানা বেঁধে ওঠা আন্দোলনে জাপান কিন্তু এখন পর্যন্ত যোগ দেয়নি। অর্থাৎ যে ২৯টি দেশ সে রকম অস্ত্রের নিষিদ্ধকরণ নিয়ে সোচ্চার, সেই দলে জাপান নেই। নেই সেই দলে এমনকি আমাদের বাংলাদেশও। ফলে খুনি রোবট নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারক ও রাষ্ট্র পরিচালকেরা কী ভাবছেন, দেশবাসীর তা জানা নেই। মানবকল্যাণের স্বার্থেই মনে হয় বিষয়টি সরকারের পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে কোন অবস্থান বাংলাদেশ গ্রহণ করছে, তা ঠিক করে নেওয়া দরকার। কেননা খুনি রোবট কিন্তু এর আগমনের আওয়াজ ইতিমধ্যে জোর গলায় দিতে শুরু করেছে এবং অবস্থান কিংবা পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব হলে তার খেসারত সারা বিশ্ববাসীকেই দিতে হবে, যে হিসাবের মধ্যে আমরাও অন্তর্ভুক্ত।

মনজুরুল হক: প্রথম আলোর টোকিও, জাপান প্রতিনিধি