ফেসবুকের ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকেই গুজবের ডালপালা?

ফেসবুক মেসেঞ্জারে ভুয়া বার্তা আসতে পারে। ছবি: রয়টার্স
ফেসবুক মেসেঞ্জারে ভুয়া বার্তা আসতে পারে। ছবি: রয়টার্স

ফেসবুক যে ভুয়া অ্যাকাউন্টে ভরা, এ কথা জানা আছে নিশ্চয়? ফেসবুকের সাম্প্রতিক ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে সে তথ্যই আবার প্রমাণ হলো। ফেসবুক এ বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩২০ কোটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট সরিয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। গত বছরের একই সময়ে মুছে ফেলা অ্যাকাউন্টের পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি।

এ সময়ের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি ১ কোটি ১৪ লাখের মতো ঘৃণাত্মক মন্তব্য সরিয়েছে। ২০১৮ সালের ওই সময়ে সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৫৪ লাখের মতো। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ফেসবুক কি সব ভুয়া অ্যাকাউন্ট ধরতে পারছে?

ফেসবুক কর্তৃপক্ষও তাদের সাইটে ভুয়া অ্যাকাউন্ট থাকার কথা স্বীকার করে নেয়। এর আগে ফেসবুকের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা (সিএফও) ডেভিড এম. ওহেনার বলেছিলেন, ফেসবুকে প্রতি মাসে যে পরিমাণ অ্যাকাউন্ট সক্রিয় হয় তার ১০ শতাংশ নকল। এ অ্যাকাউন্টগুলো সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, একই ব্যক্তির একাধিক অ্যাকাউন্ট এগুলো। এসব অ্যাকাউন্টে অন্যান্য অ্যাকাউন্টের মতো সত্যিকারের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে ফেসবুকে ২-৩ শতাংশ অ্যাকাউন্ট আছে, যা পুরোপুরি ভুয়া। এগুলো স্প্যাম ছড়ানোসহ নীতিমালা ভঙ্গের কাজ করে।

ব্যবসা ও প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডের তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রকাশের আগে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলেছিল, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমটিতে নকল অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৬ শতাংশ আর ভুয়া অ্যাকাউন্ট আছে ১ শতাংশ। অর্থাৎ সম্প্রতি ফেসবুকে ভুয়া ও নকল অ্যাকাউন্ট বেড়ে গেছে।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি জানিয়েছে, তাদের প্রায় ২৫০ কোটি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৫ শতাংশ ভুয়া অ্যাকাউন্ট। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলেও এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা যায়নি। তবে আগের তুলনায় ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার হার বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘিরে ভুয়া খবর ছড়ানো ঠেকাতে ফেসবুকের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি এ তথ্যে বোঝা যায়। ফেসবুক এ ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও ইঙ্গিত দেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ।

বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভুয়া খবর ছড়ানো ও ফেসবুকের হস্তক্ষেপের বিষয়ে সমালোচনা করে আসছেন।

প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট বিগ থিংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুক যেসব অ্যাকাউন্ট ভুয়া বলে শনাক্ত করে, এর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিকর ও ভুয়া খবর ছড়ানোর অ্যাকাউন্ট। ফেসবুক ৫ শতাংশ ভুয়া অ্যাকাউন্ট থাকার দাবি করলেও ফেসবুকে ২০ শতাংশের বেশি অ্যাকাউন্ট ভুয়া।

২০১৩ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেনের সরকারি নজরদারি বিষয়ে তথ্য ফাঁস করার পর থেকেই ফেসবুক তাদের ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করে। ওই প্রতিবেদনে কোন দেশের সরকার ফেসবুকের কাছে কী পরিমাণ তথ্য চায়, তা উল্লেখ করা থাকে। এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুক ব্যবহারকারী সম্পর্কে তথ্য পেতে ফেসবুকের কাছে অনুরোধ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে তথ্য চাওয়ার হার ১৬ শতাংশ বেড়েছে। ফেসবুক তাদের চলতি বছরের ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সরকারের পক্ষ থেকে তারা ১ লাখ ২৮ হাজার ৬১৭টি অনুরোধ পেয়েছে, যা ২০১৩ সালে এ প্রতিবেদন চালু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ।

প্রতি ছয় মাস পরপর ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদনে কোন দেশের সরকার ফেসবুকের কাছে কী ধরনের অনুরোধ জানায়, তা তুলে ধরা হয়। তবে কোন অ্যাকাউন্টের তথ্য চাওয়া হয়, তা উল্লেখ করা হয় না।

ফেসবুকের এবারের ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৯৫টি অনুরোধ করা হয়েছে। এ অনুরোধের মাধ্যমে ১২৩টি অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ৮০টি জরুরি অনুরোধ ও ১৫টি আইনি প্রক্রিয়ায় অনুরোধ করা হয়। ফেসবুক সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ৪৩ শতাংশ তথ্য সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে জরুরি অনুরোধে ৪৮ শতাংশ ও আইনি প্রক্রিয়ায় ২০ শতাংশ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির মতো ঘটনার পর থেকে ভুয়া খবর ছড়াতে ভুয়া অ্যাকাউন্টের ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। ফেসবুক দাবি করেছে, তাদের সিস্টেম উন্নত হওয়ার কারণে এখন বেশি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ধরা পড়ছে বলে সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে। ৯৯ শতাংশ ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির কয়েক মিনিটের মধ্যেই শনাক্ত করা হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে তাই ক্ষতি করার সুযোগ কম থাকে। তবে ফাঁক গলে কিছু অ্যাকাউন্ট বের হয়ে যায়।

ভুয়া এসব অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতেই মূলত ভুয়া অ্যাকাউন্টর ব্যবহার বেশি। যেমন ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার এজেন্টের পক্ষ থেকে প্রচুর ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে নির্বাচনে প্রভাব ফেলার অভিযোগ রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া শিরোনামে নানা খবর ছড়িয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার ঘটনা দেখা যায়। তবে ভুয়া অ্যাকাউন্টের এ চ্যালেঞ্জ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নেই, জার্মানিতেও এ ধরনের ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে ফ্রান্সের নির্বাচনের আগেও ৩০ হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভুয়া পেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল ফেসবুক। ফেসবুকের নিউজরুমে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে খোলা নয়টি পেজ ও ছয়টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল ফেসবুক। সমন্বিতভাবে ভুয়া পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

ফেসবুকে সব ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্টদের কাছ থেকে আসে না। রোমান্সের ফাঁদে ফেলার জন্য সুন্দরী মেয়ে বা আকর্ষণীয় পুরুষের ছদ্মবেশেও নানা অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়। এসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রেমের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হয়। তারপর জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সাইবার দুর্বৃত্তরা। ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে আরও নানা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা দেখা যায়। তবে এসব ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকে নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর আস্থা অর্জন করা এবং তার কাছ থেকে দরকারি তথ্য সংগ্রহ করে নেওয়া। পরিবার, কর্মক্ষেত্র, আশা, সমস্যাসহ নানা ব্যক্তিগত বিষয় জেনে নেওয়ার পর তা কাজে লাগিয়ে অর্থ আয় করার উদ্দেশ্য থাকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট সৃষ্টিকারীদের।

ফেসবুক সব ভুয়া অ্যাকাউন্ট ধরতে পারবে কি না, তা বলা কঠিন। ফেসবুক অনেক ভুয়া অ্যাকাউন্ট ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেয় বলে অভিযোগও রয়েছে।

ফেসবুকের ভুয়া অ্যাকাউন্টের পাল্লায় পড়া ঠেকাতে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই দিতে হবে। এ জন্য সাধারণ সাইবার নিরাপত্তার অভ্যাসগুলো গড়ে তুলতে হবে। কোনটি ভুয়া খবর, কোনটি আসল, তা বোঝার জন্য মাথা খাটাতে হবে। অনলাইনে যেকোনো খবর দেখে অন্ধবিশ্বাস‌‌ না করে তা সন্দেহ করতে হবে। ভুয়া খবরের খপ্পরে পড়ে গুজব ছড়ালে দিন শেষে নিজেকেই ভুক্তভোগী হতে হবে।