রাতের খাবারে ডেকে যেভাবে বেজোসের সর্বনাশ করেন সৌদি যুবরাজ

আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স
আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স

আমাজনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোসের মোবাইল ফোনে স্পাইওয়্যার এসেছিল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট থেকে। রাতের খাবারে ডেকে বেজোসের এ সর্বনাশ ঘটিয়েছেন তিনি। গতকাল বুধবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে তদন্তের দাবি উঠছে।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে বেজোসের ব্যক্তিগত বেশ কিছু তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর কারিগরি বিশেষজ্ঞদের একটি দল ওই ডিভাইসটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে দেখেছে। এতে দেখা গেছে, আমাজন ইনকরপোরেশনের প্রধানের ফোন থেকে তথ্য চুরির ওই ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের দিকে। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তার মোবাইল ফোনে মোহাম্মদ বিন সালমানের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভাইরাসযুক্ত ভিডিও ফাইল পাঠানো হয়েছিল।

কয়েকটি বিশেষ সূত্র বলেছে, ২০১৮ সালে সৌদি যুবরাজ সালমানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পান বেজোস। এরপরই তাঁর মুঠোফোন হ্যাকড হয়। ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণের ফলাফল মতে, যুবরাজ বিন সালমানের ব্যক্তিগত নম্বর থেকে সুরক্ষিত বার্তার সঙ্গে একটি ক্ষতিকারক ফাইল যুক্ত ছিল। ওই ফাইল খোলার পর ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক বেজোসের ফোনে অনুপ্রবেশ করে মালওয়্যার। মুঠোফোন হ্যাকড হওয়ার পর বেজোস তা তদন্তের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এফটিআই কনসাল্টিংকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগটি উঠেছে।

সূত্রগুলো বলেছে, হোয়াটসঅ্যাপে ২০১৮ সালের ১ মে ওই ক্ষতিকর ফাইলটি পাঠানো হয় সালমানের অ্যাকাউন্ট থেকে। এরপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেজোসের ফোন থেকে বিপুল তথ্য চুরি হয়।

হ্যাকিংয়ের ঘটনায় সৌদি যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার পরপরই জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তারা দ্রুত ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার বিষয়ে আরও তদন্তের দাবি করেছেন। বেজোসের মালিকানাধীন ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কলামিস্ট ছিলেন সৌদি সাংবাদিক খাসোগি।

জেনেভায় এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোটিয়ার্স অ্যাগনেস ক্যালামার্ড ও ডেভিড কাই বলেন, বেজোসের ফোন ও অন্যদের ফোন হ্যাকিংয়ের অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত তদন্তের দাবি করেছে।

বেজোসের মুঠোফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনায় যুবরাজ বিন সালমানের নাম আসার পর বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার টুইট করে ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের দূতাবাস। টুইটে বলা হয়, ‘সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জেফ বেজোসের মুঠোফোন হ্যাকের পেছনে রয়েছে সৌদি আরব। এই খবর পুরোপুরি বানোয়াট।’

সৌদি আরবের পক্ষ থেকে যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, বেজোসের ভাড়া করা নিরাপত্তা পরামর্শক এফটিআইয়ের বিশেষজ্ঞ গেভিড ডে বেকার বলেন, ফরেনসিক বিশ্লেষণে যুবরাজ মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ সৌদি আদালতের সাবেক মিডিয়া উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। খাসোগির মামলায় সৌদি তদন্তে কাহতানির সংশ্লিষ্টতা পেয়ে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে। খাসোগি হত্যায় তাঁর ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর বাইরে বেজোস ও তাঁর পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনলাইন কর্মসূচি চালিয়েছিলেন কাহতানি।

এফটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেজোস ও যুবরাজ ফোন নম্বর আদান-প্রদান করেছেন এবং ২০১৮ সালের এপ্রিলে একসঙ্গে রাতের খাবারের পর পরস্পরের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে ওই বছরের ১ মে বেজোসের আইফোন এক্স মডেলে ম্যালওয়্যার পাঠান সালমান। এ ঘটনার পর বেজোসের ফোন থেকে তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার হার ২৯ হাজার শতাংশ বেড়ে যায়।

বেজোসের মুঠোফোন হ্যাকড হওয়ার ৯ মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাবলয়েড ন্যাশনাল এনকোয়ারার বিশ্বের শীর্ষ এই ধনীর ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। এক বান্ধবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। এর জেরে ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে জেফ বেজোসের বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়। এ ছাড়া বেজোসের ফোন হ্যাকড হওয়ার পাঁচ মাস পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটে খুন হন খাসোগি।

গত বছর বেজোসের সঙ্গে সাবেক টিভি উপস্থাপিকা লরেন সানচেজের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কয়েকটি সিরিজ প্রতিবেদন করে প্রকাশ করে দ্য ন্যাশনাল এনকোয়ারার। বেজোসের পাঠানো অন্তরঙ্গ টেক্সট বার্তার ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়।

বিশ্বের শীর্ষ ধনী আমাজন ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস মার্কিন ট্যাবলয়েড সাময়িকী ন্যাশনাল এনকোয়ারারের মালিকের বিরুদ্ধে ‘নোংরা ছবি’ ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ করেন।

বিবিসি ওই সময় এক প্রতিবেদনে জানায়, বেজোস অভিযোগ করেন, ওই সাময়িকীর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান (প্যারেন্ট কোম্পানি) আমেরিকান মিডিয়া ইনকরপোরেশন (এএমআই) তাঁকে একটি অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে নিষেধ করেছে। ওই ট্যাবলয়েড পত্রিকা কীভাবে তাঁর ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করেছে, সে বিষয়ে তদন্ত করতে চান তিনি।

গত বছরের জানুয়ারিতে বেজোস ও তাঁর স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি ছাড়াছাড়ির ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণার পরপরই ন্যাশনাল এনকোয়ারার বেজোসের পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বেজোস তাঁর ব্লগ পোস্টে একটি ই-মেইলের কথা উল্লেখ করেন, যাতে এএমআইয়ের প্রতিনিধির পক্ষ থেকে তাঁকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, বেজোস ও তাঁর প্রেমিকা সাবেক টিভি উপস্থাপিকা লরেন সানচেজের অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করা হবে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার মালিক বেজোস বলেছেন, এএমআই তাঁর কাছ থেকে মিথ্যা বিবৃতি দাবি করে, ন্যাশনাল এনকোয়ারারে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।

গত বছরের মার্চে বেকারের প্রতিবেদনের পর সৌদি যুবরাজ হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। একটি বার্তায় তিনি বলেন, ‘জেফ আপনি যা শুনেছেন বা আপনাকে যা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়। সত্যটা কি আপনি জানেন, আপনার বা আমাজনের বিরুদ্ধে আমার বা সৌদি আরবের পক্ষ থেকে কিছু করা হয়নি।’

ওই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস-৩ ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে বেজোসের ফোন হ্যাকড করা হয়েছে। ইসরায়েলের ওই প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এ ঘটনায় তারা হতবাক। এ ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স