বেজোসের আইফোন হ্যাক ঘিরে রহস্য

আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস। ছবি: রয়টার্স
আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস। ছবি: রয়টার্স

আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোসের মোবাইল ফোন হ্যাকড হওয়ার পেছনে ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যারকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। হোয়টসঅ্যাপ থেকে এই ঘটনা ঘটলেও তার দায় নিচ্ছে না ফেসবুক। মুখ বুজে রয়েছে অ্যাপলও। তাহলে কী রহস্য লুকিয়ে আছে বেজোসের আইফোন হ্যাক ঘিরে?

২০১৮ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পান বেজোস। এর পরই তাঁর মুঠোফোন হ্যাকড হয়। ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণের ফলাফল মতে, যুবরাজ বিন সালমানের ব্যক্তিগত নম্বর থেকে সুরক্ষিত বার্তার সঙ্গে একটি ক্ষতিকারক ফাইল যুক্ত ছিল। ওই ফাইল খোলার পর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর মালিক বেজোসের ফোনে অনুপ্রবেশ করে ম্যালওয়্যার।

মুঠোফোন হ্যাকড হওয়ার পর বেজোস তা তদন্তের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এফটিআই কনসাল্টিংকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ওই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস-৩ ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে বেজোসের ফোন হ্যাকড করা হয়েছে।

এনএসও গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বেজোসের ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনায় তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি।

এনএসও গ্রুপের একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, তাঁরা তাঁদের সফটওয়্যারের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত এবং তাঁদের প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ফোন নম্বরে ব্যবহার করা যায় না।

অভিযোগ অস্বীকার করে ইতিমধ্যে এনএসওর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছে, তাদের প্রযুক্তি কেবল সন্ত্রাস এবং গুরুতর অপরাধ তদন্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের অভিযোগে এনএসওকে জড়িত করা মানহানিকর এবং এনএসও আইনি পথে হাঁটবে।

ফরেনসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেগাসাস-৩ স্পাইওয়্যার এনএসওর কাছ থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বরে কিনেছিল সৌদি রয়্যাল গার্ড।

এফটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেজোস ও যুবরাজ ফোন নম্বর আদান-প্রদান করেছেন এবং ২০১৮ সালের এপ্রিলে একসঙ্গে রাতের খাবারের পর পরস্পরের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে ওই বছরের ১ মে বেজোসের আইফোন এক্স মডেলে ম্যালওয়্যার পাঠান সালমান। এ ঘটনার পর বেজোসের ফোন থেকে তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার হার ২৯ হাজার শতাংশ বেড়ে যায়।

হোয়াটসঅ্যাপে নজরদারি করতে বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করেন সাইবার জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এমনই একটি সফটওয়্যারের নাম পেগাসাস। ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপে নজরদারি করা যায়। ভারতে গত লোকসভা নির্বাচনে পেগাসাস সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে দুই ডজনের বেশি শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদের ওপর নজরদারি করা হয়েছে। বিষয়টি হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে।

কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাব সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখেছে, দুই বছর ধরে ৪৫টি দেশে পেগাসাস নামের একটি স্পাইওয়্যার দিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। এ তালিকায় বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল, কানাডা, ফ্রান্স, ইসরায়েল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সুইজারল্যান্ডের নাম রয়েছে।

মুম্বাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া অঞ্চলে ‘গঙ্গা’ (গ্যাংগেজ) কোড নাম দিয়ে চলা একটি অপারেটরের সন্ধান পেয়েছে সিটিজেন ল্যাব। ওই অপারেটর দিয়ে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, হংকং, ভারত ও পাকিস্তানে ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত নজরদারি চালানো হচ্ছে।

কে হ্যাক করল বেজোসের ফোন?
অভিযোগ উঠেছে, হোয়াটসঅ্যাপে ২০১৮ সালের ১ মে ওই ক্ষতিকর এমপি ফোর ভিডিও ফাইলটি পাঠানো হয় সালমানের অ্যাকাউন্ট থেকে। এরপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেজোসের ফোন থেকে বিপুল তথ্য চুরি হয়। বেজোসের মুঠোফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনায় যুবরাজ বিন সালমানের নাম আসার পর বিষয়টি নিয়ে টুইট করে ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের দূতাবাস। টুইটে বলা হয়, ‘সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জেফ বেজোসের মুঠোফোন হ্যাকের পেছনে রয়েছে সৌদি আরব। এই খবর পুরোপুরি বানোয়াট।’

সৌদি যুবরাজও বলেন, ‘জেফ আপনি যা শুনেছেন বা আপনাকে যা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়। সত্যটা কি আপনি জানেন, আপনার বা আমাজনের বিরুদ্ধে আমার বা সৌদি আরবের পক্ষ থেকে কিছু করা হয়নি।’

অভিযোগ অ্যাপলের দিক
হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোসের হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার ঘটনায় ফেসবুকের কোনো দোষ দেখেন না ফেসবুকের নীতিমালাবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা নিক ক্লেগ। ফেসবুকের মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপের নিরাপত্তা ত্রুটির বদলে তিনি অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমের দুর্বলতার কথা বলেছেন।

ক্লেগ বলেন, ‘তাদের অপারেটিং সিস্টেম বিশেষ করে তাদের ফোনেই সমস্যা রয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তি রয়েছে। যেহেতু বার্তা পাঠানোর পর হ্যাকের কথা বলা হয়েছে, তাই মনে হচ্ছে তাদের ফোনেই কিছু থাকতে পারে। বিষয়টা এমন যে, কেউ আপনার মেইলে ক্ষতিকর কিছু পাঠাল কিন্তু আপনি তা না খোলা পর্যন্ত সক্রিয় হবে না। আমি মনে করি, এটা এ ধরনের কোনো বিষয়। তাদের অপারেটিং সিস্টেমে কোনো কিছু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।’ অ্যাপলের বিরুদ্ধে ফেসবুকের কর্মকর্তারা অভিযোগ দিলেও অ্যাপলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরেই প্রাইভেসি, বিজ্ঞাপন ব্যবসাসহ নানা বিষয়ে অ্যাপল ও ফেসবুকের মধ্যে কথা-কাটাকাটি চলছে। বেজোসের ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনায় এটি ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে।