করোনাভাইরাস: বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী হওয়ার শিক্ষা দিল

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ইম্পিরিয়াল কলেজের হ্যামারস্মিথ হসপিটাল। চারতলা ভবন। ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে চলা মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের অন্যতম একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ৩৩ জন বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন চিকিৎসা ও রসায়নে।

২০০৬ সালের এপ্রিলে প্রথম দিনে কাজে যোগ দিলাম। অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াইস, অধ্যাপক পল গ্রাসবি আর তাঁদের সেক্রেটারি সাজি সিং আমাকে নিয়ে গিয়ে কাজের জায়গা দেখিয়ে দিলেন। রিচার্ড ওয়াইস, পল গ্রাসবি, দুনিয়াজোড়া নাম তাঁদের। ‘নেচার’, ‘নিউরোলজি’, ‘ল্যানসেট’-এর মতো নামী গবেষণা পত্রিকায় প্রতিবছর তাঁদের একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন বের হয়। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, কিংস কলেজ থেকে চিকিৎসকেরা আসছেন তাঁদের কাছে গবেষণার জন্য।

প্রথম কয়েক সপ্তাহ শুধু তাকিয়ে থাকতাম ওদের দিকে। এরা প্রত্যেকে চিকিত্সক—নিউরোলজি, ক্যানসার বা অন্য কিছুর। প্রত্যেকের সঙ্গে ২০-২৫ জনের এক-একটি গ্রুপ। কেউ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক, কেউ রেডিওলজিস্ট, কেউ গণিতবিদ, সঙ্গে আছেন রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, শরীরতত্ত্ববিদ। আর আমার মতো দু-তিনজন যারা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করতে পারি। শরীরতত্ত্ব, ওষুধ কেমন করে কাজ করে, সেটা সামান্য হলেও জানি। সকাল থেকে মাঝরাত, চারতলা ভবন গমগম করছে মেধাবী মানুষে। ব্রিটিশ, জার্মান, ইতালিয়ান ও হাতে গোনা কয়েকজন এশিয়ান।

কফির ঘ্রাণের পাশ থেকে ভেসে আসছে নিত্য নতুন সব আশার কথা। মানসিক রোগ কেন হয়? মস্তিষ্কের কোন রাসায়নিক যৌগ অবসাদ, সিজোফ্রেনিয়া, পারকিনসনস বা আলঝেইমারসের মতো রোগ তৈরি করে। ক্যানসারের নতুন কোন ওষুধ দেওয়া হলো কার শরীরে? ওষুধগুলো কি ঠিকমতো কাজ করছে? টিউমারের আয়তন কি কমেছে? কীভাবে সঠিক মাপা যায়। একের পর এক ক্লিনিক্যাল স্টাডি। এমআরআই, পেইট ইমেজিং বিজ্ঞানের আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার। হাতে সময় কম।

৮টা-৫টার অফিস কখনো মাঝরাত অবধি গড়াত। জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর আমার মতো অতিসাধারণ, সবে পিএইচডি শেষ করা মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে থাকতাম ফলাফল দেখার আশায়। ধারণাটা ভুল বা সঠিক সেটি জানার আশায়। শিশুর মতো আগ্রহ নিয়ে। অধিকাংশ ট্রায়ালের ফল আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করত। উদ্দেশ্য একটাই, রোগের কারণ কী? প্রতিটি রোগের কারণ থাকে। শরীরে কোনো জীবাণু ঢুকলে বা শরীরের ভেতরে রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে কাজ না করলে রোগ হয়। রোগের প্রতিষেধক তৈরি করতে হলে রোগের কারণ জানতে হয়। রোগটি কেন হচ্ছে, এটি জানা রোগের প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

রোগের কারণ জানতে চলা গবেষণার সবচেয়ে বড় অংশ হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি, দাতব্য বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে। এসব গবেষণায় দরকার হয় একাধিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। দরকার হয় দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের। রাষ্ট্রযন্ত্রের সদিচ্ছা আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার। বন্ধু ড. গোলাম রব্বানী গবেষণাকে তালগাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘এক পুরুষ লাগালে বংশ পরম্পরায় তার ফল পাওয়া যায়। কিন্তু গাছকে পরিচর্যা করতে হয়। রাতারাতি তালগাছ বড় হয় না। ফলও দেয় না।’

এই মাত্র যে গবেষণার কথা বলছিলাম, সেখানে কোটি কোটি টাকার অর্থায়ন ছিল। অধিকাংশই ব্রিটিশ সরকারের। ২০০৮ সালে শুরু হয় আর্থিক মন্দা। কমতে থাকে সরকারি, দাতব্য বা বেসরকারি অর্থায়ন। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ সব দেশে। ছোট একটা উদাহরণ দিই—২০১৪ সালে ব্রিটেনে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা হয় ৮৫০ কোটি পাউন্ড—যা কিনা ২০০৯-এর চেয়ে ৭৮ কোটি পাউন্ড কম। ২০০৮ থেকে ২০১০। ব্রিটেনের সরকারি সংস্থায় কর্মরত সব বিজ্ঞানীকে বলা হলো বছরে বেতন এক টাকাও বাড়বে না।

অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও গবেষক খ্যাতনামা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের একটা বড় অংশ আসে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বরাদ্দ থেকে। বরাদ্দ অর্থ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ফেলো, পিএইচডি স্টুডেন্ট, কেনা হয় গবেষণার জন্য ব্যবহার করার সব সরঞ্জাম। আর একটা বড় অংশ যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোর খরচে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং নির্ধারিত হয় গবেষকদের সাফল্যের নিরিখে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বলা হয়—গবেষণার টাকা আনো, নামী জার্নালে লেখা প্রকাশ করো, পেটেন্ট আনো। বরাদ্দ কমতে থাকলে ছোট প্রকল্পের জন্যও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। ক্রমে টাকা জোগাড় করা প্রায় অসাধ্য হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় গবেষণাগারগুলো।

করোনার মতো মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে দরকার বছরের পর বছর নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। দরকার সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গবেষণা বরাদ্দে যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বে সবার আগে। ১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বরাদ্দের পরিমাণ কমছে। ২০১৮ সালে যা বরাদ্দ ছিল, তা দেশটির জিডিপির মাত্র ০.৬১ শতাংশ। আজ থেকে ৬০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার বরাদ্দ তাদের সামগ্রিক অর্থনীতির নিরিখে ২০১৮ থেকে বেশি ছিল। ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের গবেষণা ব্যয় কমাতে শুরু করে।

করোনার প্রকোপ মোকাবিলায় ইউরোপ, আমেরিকা সপ্তাহের ব্যবধানে হাজার হাজার কোটি পাউন্ড বরাদ্দ করছে। সপ্তাহের মধ্যেই গড়ে উঠছে হাসপাতাল। বিশ্ববাসী অপেক্ষার প্রহর গুনছে প্রতিষেধকের। ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে গেছেন—করোনাজনিত মহামারির। ভ্যাকসিনের জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর বরাদ্দ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। ধনী দেশগুলো কেউই বড় অঙ্কের গবেষণা বরাদ্দ দেয়নি। সবাই ভেবেছে, আমি গবেষণা না করলেও অন্য কেউ করছে। তার পরও আশার কথা, ভ্যাকসিন আসছে। কিন্তু ইতিমধ্যে হাজার হাজার প্রাণ চলে গেল।

রোগের প্রতিষেধক না থাকলে কী হয়—বুঝতে বাকি নেই কারও। গোটা বিশ্ব থমকে আছে। থমকে আছে হাজার বছরের সভ্যতার চাকা। করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ধনী দেশগুলো স্বাস্থ্য খাতের গবেষণায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেবে নিশ্চয়। অদম্য মেধাবীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন বিজ্ঞান সাধনায়। অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াইসের মতো বিজ্ঞানীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন হবেন। ছোট ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে ফুটবলার নয়, চিকিত্সক বা বিজ্ঞানী হতে চাইবে। পাঠকের প্রতি ছোট একটা প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করি। আপনার বা আপনার অত্যন্ত কাছের মানুষের ইনফেকশন হলে যে অ্যান্টিবায়োটিক খান সেটি কে আবিষ্কার করেছিল, জানেন?

স্যার আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং। সেই আবিষ্কারের গল্প না হয় আরেক দিন বলব। সেই পর্যন্ত নিরাপদে থাকুন। বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে শুরু করুন। ছোটদের বিজ্ঞানমনস্ক করুন।

ড. সুব্রত বোস: লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
ই-মেইল: [email protected]