করোনা যুদ্ধ ও করণীয়: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

‘কভিড-১৯’ হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া করোনা ভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ এর অফিশিয়াল নাম। সম্প্রতি কোভিড-১৯ একটি আন্তর্জাতিক ত্রাস হয়ে উঠেছে।

করোনা কী?
ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে যে ভাইরাস দেখলে মনে হয় এরা মাথায় মুকুট পরে আছে, সেগুলোই করোনাভাইরাস। ল্যাটিন ভাষায় একে বলে ‘করোনাম’ (Coronam)। জানা যায়, মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন মোট সাত ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে। মার্কিন সংস্থা সেন্টারস ফল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সেগুলো হলো—

১. 229E (আলফা করোনাভাইরাস)

২. NL63 (আলফা করোনাভাইরাস)

৩. OC43 (আলফা করোনাভাইরাস)

৪. HKU1 (বিটা করোনাভাইরাস)

৫. MERS-CoV (বিটা করোনাভাইরাস, যার কারণে Middle East Respiratory Syndrome or MERS হয়): ২০১২ সালে সৌদি আরবে প্রথমবার এই ভাইরাসের নাম শিরোনামে উঠে এসেছিল।

৬. SARS-CoV (বিটা করোনাভাইরাস, যার কারণে Severe Acute Respiratory Syndrome or SARS হয়): ২০০৩ সালে এশিয়ায় এই ভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে ২০০৪ সালের পর এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আর কোনো রিপোর্ট সামনে আসেনি।

৭. SARS-CoV-2 (নভেল করোনাভাইরাস, যার কারণে Corona Virus Disease 2019 হয়): এই ভাইরাসই করোনাভাইরাস নামে পরিচিত। করোনার CO, ভাইরাসের VI, ডিজিজের D ও প্রথম শনাক্তের সাল 19 নিয়ে হয়েছে COVID-19। এটি প্রথম চীনের উহানে আবির্ভূত হয়।

মানুষ সাধারণত করোনাভাইরাস 229E, NL63, OC43, HKU1 ভাইরাসের সংক্রমিত হতে পারে, যারা মানুষের দেহে সাধারণ সর্দি-কাশি ব্যতীত অন্য কোনো উপসর্গ বা রোগ সৃষ্টি করত না। কিন্তু কখনো করোনাভাইরাসগুলো বিভিন্ন প্রাণীকে সংক্রমিত ও মিউট্যান্ট করে এ পর্যন্ত তিনটি নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে (সার্স, মার্স ও উহান করোনাভাইরাস) যেগুলো মানবসম্প্রদায়ে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করার ঝুঁকি বহন করে।

ছড়ানো/ বিস্তারের ধরন:
• করোনাভাইরাসও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে।

• বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের সময় মুখের হাঁচি, কাশি, লালা বা থুতু থেকে সরাসরি ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে সংক্রমিত হতে পারে।

• অন্যদিকে জনসমাগমস্থলে কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিলে বা ভাইরাসযুক্ত হাত দিয়ে ধরলে কাছাকাছি পৃষ্ঠতলে যেমন টেবিলের তল, দরজার হাতল, বাতির সুইচ, পানির কল, খাটের খুঁটিতে বা সেলফোনে ভাইরাস লেগে থাকতে পারে। সেখান থেকে পরোক্ষভাবে অন্যদের মধ্যে সেটি ছড়াতে পারে।

• এ ছাড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার সময়—যেমন ফুসফুস বা শ্বাসনালির চিকিৎসার সময়ে দেহ থেকে নিঃসৃত ভাইরাসের কণাগুলো বাতাসে ভেসে একাধিক চিকিৎসাকর্মীকে সংক্রমিত করতে পারে এবং সাবধানতা অবলম্বন না করলে হাসপাতালের সবার মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইনকিউবেশন পিরিয়ড:
ভাইরাসটির সংক্রমণ ও লক্ষণ প্রকাশের অন্তর্বর্তী কাল (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) এখনো নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সংক্রমণের মোটামুটি ১-১৪ দিনের মধ্যেই রোগের উপসর্গ দেখা যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

লক্ষণ ও উপসর্গ:
• এই ভাইরাসে আক্রান্তদের আপাতভাবে সুস্থ মনে হতে পারে।
• ফ্লু-এর মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এসব উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি ইত্যাদি।
• কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ঊর্ধ্ব-শ্বাসতন্ত্রের কিছু লক্ষণ—যেমন হাঁচি, নাক দিয়ে পানি পড়া, গলাব্যথা ইত্যাদি।
• মাথা ব্যথা, মাংসপেশিতে বা মাংসপেশির সংযোগে ব্যথা ইত্যাদি।
• গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল উপসর্গ যেমন বমি-বমিভাব, বমি, ডায়রিয়া ইত্যাদিও হতে পারে।

রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি:
• RT-PCR পরীক্ষা। রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ-পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগ নির্ণয়ের জন্য ভাইরাসের জিনগত উপাদান শনাক্ত করা হয়।
• রোগীদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই ভাইরাসের কারণে তাদের শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা হ্রাস পায় (Leukopenia +Lymphopenia)।
• ইমিউনিঅ্যাসে-সেরোলজি পরীক্ষায় এলিসা অ্যান্টিবডি পরীক্ষণ-সামগ্রী ব্যবহার করা হয়, যেন হোস্ট দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তা শনাক্ত করে রোগ নির্ণয় করা যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে IgM ও IgG অ্যান্টিবডির উপস্থিতি জানা যাবে ও ১৫ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যাবে।
• সিটি স্ক্যান-বুকের সিটি স্ক্যান ফুসফুসের প্যাথোলজি শনাক্ত ও একে শ্রেণিবিন্যস্ত করতে সহায়তা করে এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণের কিছু দিক চিহ্নিত করতে পারে। ফুসফুসের দু পাশের কয়েকটি অংশে কাচের মতো স্বচ্ছ সাদা অংশ দেখা যায়, যা চারদিকে (peripheral) অথবা পেছনে বিন্যস্ত থাকে।

কোভিড-১৯ প্রতিরোধে করণীয়:
১. সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মানতে হবে। করোনাভাইরাস কোনো লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই দু সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যেকোনো ব্যক্তির দেহে তার অজান্তেই বিদ্যমান থাকতে পারে। করোনাভাইরাস বহনকারী ব্যক্তি যদি কোনো কারণে হাঁচি বা কাশি দেন, তাহলে তার আশপাশের বাতাসে ৩ থেকে ৬ ফুট দূরত্বের মধ্যে করোনাভাইরাসবাহী জলীয় কণা (ড্রপলেট) বাতাসে ভাসতে শুরু করে এবং ওই পরিধির মধ্যে থাকা যেকোনো ব্যক্তির দেহে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি প্রবেশ করতে পারে। এ কারণে জনসমাগম বেশি—এমন এলাকা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে, যাতে বাতাসে ভাসমান সম্ভাব্য করোনাভাইরাস কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ না করতে পারে।

২. কারও সঙ্গে করমর্দন করা (হাত মেলানো) বা কোলাকুলি করা বা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে এটি ছড়াতে পারে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

৩. নাক, মুখ ও চোখ হাত দিয়ে স্পর্শ না করা। কারণ, করোনাভাইরাস কেবলমাত্র নাক, মুখ ও চোখের উন্মুক্ত শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে।

৪. মানুষ হাত দিয়ে স্পর্শ করে, যেমন দরজার হাতল, কম্পিউটারের কিবোর্ড ও মনিটরের পর্দা, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো বহুল ব্যবহৃত আসবাব ইত্যাদি নিয়মিতভাবে কিছু সময় পরপর জীবাণু নিরোধক স্প্রে বা দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

৫. নিয়মিত কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবানের ফেনা তুলে ভালো করে হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করা।

৬. পরিবেশ পরিষ্কার করে করোনাভাইরাস মুক্তকরণ—যেমন রাস্তায় ও যত্রতত্র থুতু ফেলা যাবে না। কারণ, থুতু থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে।

৭. পরিচিত কারও করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা জরুরি ফোনে যোগাযোগ করতে হবে, যাতে তাকে দ্রুত পরীক্ষা করা যায় এবং প্রয়োজনে সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) করে রাখা যায়।

৮. হাসপাতালে ও অন্য কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্যই বিশেষ চিকিৎসা মুখোশ ও হাতমোজা পরিধান করতে হবে, যাতে ভাইরাস এক রোগী থেকে আরেক রোগীতে না ছড়ায় এবং চিকিৎসাকর্মী নিজে সংক্রমিত না হন।

কোভিড-১৯ টিকা:
কোভিড-১৯ টিকা একটি প্রকল্পিত টিকা, যা করোনাভাইরাস রোগের ২০১৯ (কোভিড-১৯) বিরুদ্ধে কাজ করবে। টিকা আবিষ্কারের জন্য বেশ কিছু প্রচেষ্টা চলছে। তবে কোনো টিকা এখনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল উত্তীর্ণ হয়নি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় যে, তারা গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণ সৃষ্টিকারী SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে কাজ করার মতো কোনো টিকা আগামী ১৮ মাসের মধ্যে (অর্থাৎ ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধের আগে) সবার জন্য সহজলভ্য হবে বলে আশা করছে না। ২০২০ সালের মার্চের প্রথম দিকে আলাদাভাবে প্রায় ৩০টি সম্ভাব্য টিকা নিয়ে কাজ চলছিল।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগসংক্রান্ত জাতীয় সংস্থা (এনআইএআইডি) মডার্না কোম্পানির সঙ্গে মিলে করোনাভাইরাসের পৃষ্ঠতলের কাঁটাগুলোর সঙ্গে মিলে যায়—এমন আরএনএ টিকা তৈরির জন্য কাজ করছে। এনআইএআইডি এমআরএনএ-১২৭৩ নামের একটি টিকা পরীক্ষার জন্য সিয়াটল নগরীতে ৪৫ জন স্বাস্থ্যবান পূর্ণবয়স্ক মানুষকে নিবন্ধন করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, তারা একটি আণবিক ক্ল্যাম্প টিকা তৈরির চেষ্টা করছে, যা অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য ভাইরাসের প্রোটিনকে বংশানুগতভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে।

কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা:
শুধু উপসর্গভিত্তিক সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে চীনে প্রায় অনেক ড্রাগ ব্যবহার করেছে। তারা দেখার চেষ্টা করেছে কোনটার response ভালো হয়। শুরুতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা Antiretroviral therapy ব্যবহার করেছে, যা ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র HIV-এর বিরুদ্ধে।

আবার কোভিড-১৯ আক্রান্ত যেসব রোগী খুব খারাপ অবস্থার দিকে চলে যায়, multiorgan failure ডেভেলপ করে, তাদের ক্ষেত্রে এর কারণ হিসেবে দেখা যায় cytokine storm। তাই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে তারা Chloroquine /Hydroxychloroquine (antimalarial) ব্যবহার করেছে এবং good response পেয়েছে! Hydroxychloroquine কাজ করে immunomodulater হিসেবে এবং cytokine রিলিজে বাধা প্রদান করে। যদিও এগুলোর কোনো randomized controlled trial নেই, তবুও কোনো ইমার্জেন্সি যদি কারও ক্ষেত্রে হয়ই, যখন সহায়ক চিকিৎসা ছাড়া আর কিছু করার নাই, তখন এগুলো দিয়ে শেষ চেষ্টা করা যাবে।

আর একটা বিষয় হলো জিংক (Zn) যেকোনো viral activity কমায়। আমাদের শরীরে জিংক স্টোরেজ আরও বাড়াতে জিংক বেশি আছে এমন খাবার—যেমন মাংস, শিম জাতীয় খাবার, বিচি জাতীয় খাবার, জিরা-কালো জিরা, ডিম-দুধ, খোসাসহ খাদ্যশস্য একটু বেশি খাওয়া ভালো।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে কর্তৃপক্ষ গৃহীত জরুরি পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাসমূহ:
ভাইরাস সংক্রমণের হার কমাতে পারলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণক্ষমতার ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপের ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। এ জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরীক্ষণ, বিচ্ছিন্ন, সঙ্গনিরোধ ও প্রাদুর্ভাব বেশি এমন অঞ্চলকে অবরুদ্ধ করার মতো পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়।

পরীক্ষণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাস মহামারির বিস্তার রোধে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো সংক্রমিত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করে আশপাশের মানুষ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা। এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব একটি ব্যাপক ও নিবিড় পরীক্ষণ কর্মসূচি সম্পাদন করা অত্যাবশ্যক। তবে অনেক দেশেই সীমিতভাবে কেবলমাত্র সন্দেহজনক ক্ষেত্রে বিদেশফেরত, বৃদ্ধ বা রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষণ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। যেসব ব্যক্তির মৃদু উপসর্গ আছে বা কোনো উপসর্গই নেই—এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষণে বাধা দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষণ ছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্নকরণ ও এর সাহায্যে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভঙ্গ করা সম্ভব নয়। পরীক্ষণ, শনাক্তকরণ ও বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস মহামারির বিস্তার রোধে সফলতার দেখা পাওয়া গেছে।

অন্তরণ বা বিচ্ছিন্নকরণ (আইসোলেশন)
যেসব ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাদের কোনো হাসপাতালে বা স্থাস্থ্যকেন্দ্রের বিশেষ বিভাগে আইসোলেশনে রাখা হয়, যাতে তারা অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে না পারে।

সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন)
যেসব ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, অথচ একাধিক উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তাদের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ ভবনে বা নিজ বাসভবনে সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এখানে স্মরণীয় যে, দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি স্বল্প খরচে ও দ্রুত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা বিশ্বের সিংহভাগ দেশেই এখনো সুলভ নয়। এ ছাড়া নীরব বাহকদের কাছ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি বলে কেবল বিদেশফেরত বা করোনা-আক্রান্ত এলাকায় ভ্রমণজনিত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ করোনাভাইরাসবাহী ব্যক্তির স্বেচ্ছায় বা আরোপিত সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থা এককভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে আদৌ যথেষ্ট কার্যকর কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

অবরুদ্ধকরণ বা লকডাউন
যখন আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাগুলো ব্যর্থ হয়, তখন সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সমগ্র দেশের ওপর অবরুদ্ধকরণ (লকডাউন) ব্যবস্থা জারি ও বলবৎ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে লোকেদের বাসগৃহ থেকে বের হওয়া, পরিবহন ব্যবহার করা, কর্মস্থলে গমন, জনসমাগম হয় এমন স্থলে যাওয়া, অত্যাবশ্যক নয় এমন সব কাজ করা ইত্যাদির ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

উপসর্গহীন নীরব বাহক ও সংক্রামকের ভূমিকা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটি বিরাট অংশ (ক্ষেত্রভেদে প্রায় ৬০ শতাংশ বা তারও বেশি) কোনো উপসর্গই প্রকাশ করে না এবং নীরবে ও নিজের অজান্তে রোগটি ছড়াতে থাকে।

১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। COVID-19 মহামারি শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো রোগটি বড় আকার ধারণ করেনি। তার আগেই সরকারের তরফে বিপুল ব্যবস্থা তথা জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরীক্ষণ, আইসোলেশন, করোয়ারেন্টিন ও লকডাউনের মতো পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান জোর দিয়ে বলেছেন, মানুষকে বাইরে চলাফেরা না করে ঘরে থাকতে বলে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সময় পাওয়া যাবে এবং লকডাউন দিয়ে হয়তো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমানো যাবে। এর বেশি কিছু নয়। এসব দিয়ে করোনাভাইরাস দূর করা যাবে না, মহামারি ঠেকানো যাবে না। এর বিরুদ্ধে সবাইকে আক্রমণাত্মক হতে হবে। তাই সন্দেহভাজনদের সন্ধান করুন, বিচ্ছিন্ন করুন, করোনার পরীক্ষা করুন এবং চিকিৎসা করুন। এটাই সর্বোত্তম উপায়।

সচেতনতা স্বত্বেও ‘ডিজাস্টার ম্যানেজ’ করতে হিমশিম খেয়ে গেছে চীন, ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলো। মরেছেন চিকিৎসকেরাও। পাশাপাশি মনে করিয়ে দিই, অতীতে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক খারাপ করার প্রচেষ্টা ও আলোচনা করা হয়েছে। চিকিৎসকদেরই তো মূল ভিলেন সাজানো হয় স্বাস্থ্য সেবার সমস্যা ও মূল্য বৃদ্ধির জন্য। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও বাড়েনি সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসায় চিকিৎসকের ফি। বরং নিখরচায় সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন চিকিৎসকেরা। চীন, ইতালি, স্পেন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রে যখন সবাই পালাচ্ছেন সংক্রমিত মানুষদের ফেলে, তখন একমাত্র চিকিৎসকেরাই ছুটে যাচ্ছেন তাঁদের কাছে। এই সেবা দিতে গিয়ে মারাও যাচ্ছেন বহু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। দেশরক্ষার স্বার্থে, দেশের মানুষদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা। বাংলাদেশেও সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক চিকিৎসক। এর আগেও এমন হয়েছে—ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। অথচ কখনোই মানুষের নিরাপত্তা রক্ষায় সৈনিক হিসেবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা কখনোই সেভাবে আলোচিত হয় না। কারণ, অন্য মানুষকেই আমরা শত্রু মনে করি, রোগ-জীবাণুদের নয়। অন্য দেশের বা শত্রু মানুষকে মারতে পারলেই আমাদের একমাত্র বিজয়। সেই কারণেই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয় না কিছুতেই।

দেশে গত ২৮ মার্চ পর্যন্ত কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছে সর্বমোট ১,০৬৮ জনের। এর মধ্যে পজিটিভ পাওয়া গেছে ৪৮ জনের ও মোট সুস্থ হয়েছেন ১৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং চারজন আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। দেশে মোট মৃত্যু ৫ জনের এবং গত ৩ দিনে নতুন করে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেনি। (সূত্র: আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ফেজে গেছে বলে এরই মধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এর মানে কী? একেকটা দিন না, এখন একেকটা সেকেন্ড আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। লকডাউন, মানে ‘কমপ্লিট লকডাউন’ করা প্রয়োজন। সরকার নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সম্ভাব্য রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করছে তাদের বাসা থেকে। এর মাধ্যমে আক্রান্ত রোগী অন্যকে ছড়ানোর আশঙ্কা কমে আসবে। শুরুর দিকে পরীক্ষাসামগ্রীর পরিমাণ ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এখন বড় মেডিকেল কলেজ ও বিভাগীয় হাসপাতালে কোভিড-১৯ এর ড্রাইভ-থ্রু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে নমুনা সংগ্রহ করে অনেক দ্রুত ও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারেন।

কোভিড-১৯ কিন্তু ঢাল-তলোয়ারহীন চিকিৎসকদেরও মাফ দেবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। অ্যাপোলো হাসপাতালে অস্বাভাবিক নিউমোনিয়ায় ভুগে রুগীর মৃত্যুর পর পাঁচ চিকিৎসক কোয়েরেন্টিনে আছেন। এভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামের (PPE) অভাবে চিকিৎসকগণ অসুস্থ হতে থাকলে বা মারা গেলে বা কোয়ারেন্টিনে যেতে বাধ্য হলে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় কী ধস নামবে চিন্তা করুন।

সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের জন্য। সুধী সমাজের সদস্য হিসেবে আপনি কী উদ্যোগ নেবেন? নিজ জেলায় বিএমএ (BMA), চিকিৎসক ও সুধী সমাজের সহায়তায় কিছু করা সম্ভব। যেমন—
১. প্রতি জেলায় তিনটি ভবন দরকার—
• একটি রোগীদের জন্য, যেখানে থাকতে হবে শয্যা, দিতে হবে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ।
• একটি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবাদানকারী লোকেদের জন্য। কারণ, এই সময়ে তাঁদের পরিবার ছেড়ে আলাদাই থাকতে হবে।
• একটি ল্যাব ও প্রয়োজনীয় রসদ সংক্রান্ত কাজের জন্য। বেসারকারিভাবেও পিপিই তৈরি করতে হবে।
২. পরিস্থিতি মোকাবিলায় তহবিল তৈরি করতে হবে।

সবশেষে, আসুন সবাই সরকার ঘোষিত নিয়মগুলো মেনে চলি, নিজে সুস্থ থাকি ও অন্যকেও সংক্রমণের থেকে সুরক্ষায় সহায়তা করি।

লেখক: অধ্যাপক, শিশু সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ই-মেইল: [email protected]