করোনাকালে বিল গেটসকে নিয়ে যত আলোচনা

বিল গেটস। ছবি: এএফপি
বিল গেটস। ছবি: এএফপি

মাইক্রোসফটের সহ–প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস প্রায় সবার পরিচিতি। এবারের কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনলাইনে চাউর হয়েছে। যদিও এসব ‘আজেবাজে’ কথা তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন, তবু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা চলছেই। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে কানাডার ভ্যাংকুভারে এক সম্মেলনে বিল গেটস স্টেজে উঠে এক মারাত্মক সতর্কতা জারি করেন। সেই ভিডিও ঘিরেই এখন ছড়িয়েছে নানা তত্ত্ব।

বিল গেটস ওই সময় বলেছিলেন, ‘আগামী কয়েক দশকে যদি কোনো কিছু এক কোটির বেশি মানুষকে হত্যা করে, তবে তা যুদ্ধের চেয়েও অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ গেটসের ওই কথা ধরে বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো তখন এতটা আলোচিত হয়নি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর সেই মন্তব্যের ভিডিও ফুটেজ সাড়ে ছয় কোটির বেশিবার দেখা হয়েছে। অনেকেই ওই সময় তাঁর ওই কথার পেছনের গল্প জানতে আগ্রহী ছিলেন। কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী অভিজাত শ্রেণির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অন্যদের অনেকে বিশ্বাস করেন, তিনি বিশ্বের জনসংখ্যা কমানোর প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখনো কেউ কেউ মনে করছেন, তিনি ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করে তুলছেন, যার মধ্যে তিনি মাইক্রোচিপ বসাবেন।

ফার্স্ট ড্রাফট নিউজের ফ্যাক্ট-চেকার ররি স্মিথ বলেছেন, ‘বিল গেটসকে ঘিরে অগণিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে। তিনি অনেকটাই ভুডুর পুতুলের মতো, যাঁকে ঘিরে একেক সম্প্রদায় নিজেদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিজেদের মতো করে ছড়াচ্ছে। অবশ্য তাঁর ভুডু পুতুল হওয়া খুব বিস্ময়কর নয়, কারণ তিনি সব সময় জনস্বাস্থ্য নিয়ে সামনে এসেছেন।’

নিউইয়র্ক টাইমস ও জিগন্যাল ল্যাবসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বিল গেটসকে মিথ্যাভাবে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুক্ত করার তত্ত্বগুলো টেলিভিশন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ১২ লাখ বার উল্লেখ করা হয়েছিল। এ ধরনের অধিকাংশ কনটেন্ট পাবলিক গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছে, যা লাখ লাখ বার শেয়ার হয়েছে।

ফার্স্ট ড্রাফট নিউজ দাবি করেছে, চীনা ভাইরাল ভিডিও সাইট টিকটক ষড়যন্ত্র ছড়ানোর নতুন প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।

বিবিসির গবেষক দল বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছে, যাতে দাবি করা হয়েছে, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আফ্রিকা ও ভারতে শিশুদের টিকা পরীক্ষা করেছে, যা হাজারো শিশুর মৃত্যুর কারণ। এমনকি বিল গেটসকে ভারতে বিচারের মুখোমুখি করা হবে—এমন দাবিও ছিল। কেনিয়াতে গর্ভপাতের ওষুধের অন্তর্ভুক্ত একটি টিটেনাস ভ্যাকসিন তৈরির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

নিউ আমেরিকান ম্যাগাজিনের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, ভ্যাকসিন ও গর্ভপাতের মাধ্যমে ব্যাপক জনসংখ্যা কমাতে কাজ করছেন বিল গেটস। তাঁর সঙ্গে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক থাকার কথাও বলা হয়। দুই লাখের বেশি ভিডিও দেখার পাশাপাশি সাড়ে ছয় হাজারবার তা শেয়ার হয়েছে। একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, মানুষের শরীরে মাইক্রোচিপ বসাতে চান গেটস। এ ভিডিও ২০ লাখ বার দেখা হয়েছে।

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস যেখানে তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডার সঙ্গে পরিচালিত দাতব্য সংস্থা থেকে কোটি কোটি ডলার বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় ঢালছেন, তিনি কেন এ সময় ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের লক্ষ্যে পরিণত হলেন? মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব–সম্পর্কিত বইয়ের লেখক অধ্যাপক জোসেফ উসকনস্কি বলেন, বিল গেটস ধনী ও বিখ্যাত বলেই তাঁকে নিয়ে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উত্থান। ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো শক্তিশালী বা ক্ষমতাশালী লোককে ভয়ংকর কাজ করার জন্য অভিযুক্ত করে তোলে। তত্ত্বগুলো মূলত একই, কেবল নাম পরিবর্তন হয়। বিল গেটসের আগেও অনেকে এর শিকার হয়েছেন।

যদিও এই জাতীয় ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সত্যের ছিটেফোঁটা নেই। তবু মানুষ এর পেছনে ছুটতে শুরু করে। ইয়াহু নিউজ ও ইউগভের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এক–চতুর্থাংশ নাগরিক ও ৪৪ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থক বিশ্বাস করেন, বিল গেটস কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মানুষের ত্বকের নিচে মাইক্রোচিপ বসাতে চান।

বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন গত বছর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা তহবিল দিয়েছিল, যা ডাইয়ের ধরনে রোগীর টিকাদানের ইতিহাস সংরক্ষণের সম্ভাবনা দেখেছিল। এটি খালি চোখে অদৃশ্য হবে এবং ভ্যাকসিন হিসেবে একই সময়ে ত্বকের নিচে সরবরাহ করা যেতে পারে।

স্মিথের মতে, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল নির্ণয় করা কঠিন, তবে মনে করা হয় ইন্টারনেট তা আরও ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী মহামারি চলাকালে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো ছড়ায় বেশি, কারণ মানুষ মানসিকভাবে দুর্বল থাকে।

বিবিসিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বলেছে, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া এবং তা জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি করতে পারে, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’

তবে যাঁকে ঘিরে এসব ষড়যন্ত্র, সেই বিল গেটস বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা বিরক্তিকর যে এ ধরনের পাগলামি রয়েছে। যখন আমরা ভ্যাকসিনটি প্রস্তুত করব, আমরা চাইব জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ এটি গ্রহণ করবে। যদি তাঁরা শুনে টিকা গ্রহণে অনাগ্রহী হয়, তবে এই রোগে মানুষ মারা যেতে থাকবে।’

বিল গেটস আরও বলেছেন, ‘আমি একরকম অবাক হয়েছি এর মধ্যে আমাকেও টেনে আনা হয়েছে। আমরা অর্থ ঢালছি, চেক লিখছি, আর অবশ্যই আমরা শিশুদের রোগ থেকে রক্ষা করার বিষয়ে চিন্তা করি। তবে এর সঙ্গে চিপ সেট করা বা এসব কিছুর কোনো সম্পর্ক নেই। এসব শুনে প্রায়ই হাসতে হয়।’