মরিস হিলম্যান: ৪০ ভ্যাকসিনের আবিষ্কারক

মাইক্রোবায়োলজিস্ট মরিস হিলম্যান
মাইক্রোবায়োলজিস্ট মরিস হিলম্যান

করোনাভাইরাস মহামারিতে যখন বিশ্ব একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় দিন গুনছে, তখন স্মরণ করা হচ্ছে লাখো শিশুর জীবন বাঁচানো মাইক্রোবায়োলজিস্ট মরিস হিলম্যানকে। তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে সফল প্রতিষেধক আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত। কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে একটি মহামারি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯১৯ সালের ৩০ আগস্ট জন্ম নেওয়া এই মাইক্রোবায়োলজিস্ট সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিনের আবিষ্কারক। তাঁর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পূর্বে নিউমোনিয়া থেকে শুরু করে খুব সাধারণ রোগেই মানুষ মারা যেত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বিখ্যাত এ আবিষ্কারকের জীবনের নানা দিক।

১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে হংকং থেকে রহস্যময় এক রোগ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। চিকিৎসাকর্মীরা শিশুদের বেশি আক্রান্ত হতে দেখেন। এই সময় নগরীর ১০ শতাংশের বেশি লোক ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিল। বৈজ্ঞানিকেরা চুপ করে থাকলেও মার্কিন ভাইরোলজিস্ট মরিস হিলম্যান হুমকির বিষয়টি ধরতে পারেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একটি মহামারি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন, এটি হয়তো ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন কোনো স্ট্রেন, যা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওই সময়ে শরতে যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাসটি এসে পৌঁছায়। তিনি তখন ভ্যাকসিন নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর কাজ প্রাণঘাতী ভাইরাস সংক্রমণ থেকে লাখ লাখ মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়। হিলম্যান এরপরে তাঁর ক্যারিয়ারজুড়ে আরও অনেক ভ্যাকসিন তৈরি করে অনেক মানুষকে রক্ষা করেছেন।

বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী স্প্যানিশ ফ্লুর সময় জন্ম নেওয়া হিলম্যান বেড়ে ওঠেন মনটানার মাইলস সিটিতে। মন্দার সময়টাতে জেসি পেনি স্টোরে সহকারী ব্যবস্থাপকের একটি চাকরি জুটে যাওয়ার পর এটাই ক্যারিয়ার ভেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে তাঁর বড় ভাই তাঁকে আরও পড়াশোনা করতে বললেন। বললেন উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে। পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে তিনি মনটানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে স্নাতক শ্রেণিতে প্রথম হন। তিনি যে গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আবেদন করতেন, সব কটিতেই জায়গা পেতেন তিনি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজির ডক্টরাল পর্যায়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থান তিনি প্রমাণ করলেন ক্লামেডিয়া আসলে প্যারাসাইট ব্যাকটেরিয়া, এটি ভাইরাস নয়। তাঁর এ আবিষ্কার চিকিৎসকদের এ–সংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় ব্যাপক কাজে লেগেছিল।

ক্যারিয়ার নিয়ে অধ্যাপকদের কথা শোনেননি হিলম্যান। তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একাডেমিয়াতে যোগ না দিয়ে হিলম্যান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে যোগ দেন। তিনি মনে করতেন, তাঁর গবেষণার ফল রোগীদের দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এতে সুবিধা পাবেন। তিনি নিজের বেছে নেওয়া পথে ভুল করেননি। ক্যারিয়ারজুড়ে ৪০টির বেশি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন তিনি, যা বিশ্বজুড়ে অনেক রোগ প্রতিরোধ করেছে এবং লাখ লাখ মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছে।

নিউ জার্সির ইআর স্কুইব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চার বছর কাজ করার পর হিলম্যানকে ওয়াল্টার ওয়াশিংটন ডিসির রিড আর্মি মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বদলি করা হয়। তিনি সেখানে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেখানে তিনি প্রমাণ করেন ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের রূপান্তর হয় (মিউেটশন)। এর ফলে শরীরে আগে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা কাজে দেয় না। তিনি ব্যাখ্যা দেন, একবার ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন দিলে তা আজীবন সুরক্ষা দেবে না, যা পোলিও বা স্মলপক্সের ভ্যাকসিন দিতে পারে।

এই গবেষণার মাধ্যমে হিলম্যান নিশ্চিত হয়ে ওঠেন যে হংকংয়ের ভাইরাস বিদ্যমান স্ট্রেনগুলো থেকে যথেষ্ট আলাদা হতে পারে এবং এভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশগুলোতে এলে তা মারাত্মক হতে পারে। ১৯৫৭ সালের ১৭ এপ্রিল যখন নিউইয়র্ক টাইমসের একটি কপি তুলে নেন এবং হংকং পরিস্থিতি পড়েন, তখন তিনি বলেছিলেন, এটা তো মহামারি। তিনি পরদিনই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সেখানকার নমুনা সংগ্রহ করেন। মাসখানেক পরে তিনি হংকং ভ্রমণ করা নৌবাহিনীর এক সদস্যের গারগেল করা লবণপানি নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করেন। হিলম্যান শত শত সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকের অ্যান্টিবডির বিরুদ্ধে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেন। তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জার এই স্ট্রেনের অ্যান্টিবডিসহ কোনো একক ব্যক্তিকে খুঁজে পাননি। নতুন ভাইরাসটির নমুনা তিনি অন্য গবেষণা সংস্থায় পাঠালেন। তিনি জানতে পারলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে টিকে যাওয়া কিছু বয়স্ক নাগরিকের অ্যান্টিবডি সুরক্ষা আছে। অর্থাৎ নতুন ভাইরাসটিতে সবার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরে এক সাক্ষাৎকারে হিলম্যান বলেছিলেন, ১৯৫৭ সালে কেউই বিষয়টিকে ধরতে পারেনি। সেনাবাহিনী ধরতে পারেনি এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এটা ধরতে পারেনি।

এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সময় ছিল খুব কম। হিলম্যান দ্রুত ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ শুরু করলেন এবং তার নমুনা থেকে ভ্যাকসিন তৈরি করতে বললেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তাঁর কাজ তখনো পর্যালোচনা করেনি। তবে ওষুধ কোম্পানিগুলো রাজি হয়েছিল। তবে তখন নিয়মকানুন এতটা কঠোর ছিল না। বর্তমান সময়ে এ ধরনের কাজ প্রায় অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লু আসার আগেই ৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন হিলম্যান তৈরি করতে পেরেছিলেন। বিশ্বজুড়ে ভাইরাসটি ১১ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।

ওই সময়ে মার্কিন সার্জন জেনারেল লিওনার্ড বার্নি বলেছিলেন, তাঁদের হাতে ভ্যাকসিন না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে আরও লাখ লাখ মানুষ মারা যেত। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী হিলম্যানকে তাঁর কাজের জন্য সম্মানজনক স্বীকৃতি দেয়। হিলম্যান বলেন, ‘আমরা সেবারই কোনো ভ্যাকসিন দিয়ে মহামারিটি এড়িয়ে যেতে পেরেছিলাম।’

১৯৬৩ সালের মার্চে হিলম্যানের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে জেরিল লিন মাঝরাতে উঠে গলাব্যথা ও গাল ফোলার কথা জানায়। তাঁর মাম্পস হয়েছিল। যদিও এটি প্রাণঘাতী নয়। তবুও অনেক সময় এটি মস্তিষ্কে প্রদাহ, প্যানক্রিয়াসে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ১০ হাজার মাম্পসের রোগী ছিল। হিলম্যান মেয়েকে বিছানায় রেখে তার গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর ওই নমুনা থেকে তিনি ভাইরাসটি গবেষণা শুরু করেন এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান। তিনি মুরগির ওপর ভাইরাসটির প্রয়োগ শুরু করেন। তিনি একপর্যায়ে ভাইরাসটির দুর্বল সংস্করণ খুঁজে বের করেন, যা মানুষের শরীরে ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করলে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি করে। ১৯৬৬ সালে নিজের মেয়ে লিনের ছোট বোন ক্রিস্টেনকে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দেন হিলম্যান। বড় বোনের কাছ থেকে পাওয়া ভাইরাসে ছোট বোন সুরক্ষিত থাকছে, যা ওই সময় মেডিসিনের ইতিহাসে অনন্য নজির ছিল।

হিলম্যান পরে দ্য ভ্যাকসিন মেকার্স প্রজেকটসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সাধারণত বড় বোনের কাছ থেকে ছোট বোন সংক্রমিত হয়, কিন্তু প্রতিরোধী পাওয়া যায় না। ভ্যাকসিন পরীক্ষার এক বছর পর হিলম্যান মাম্পস ভ্যাকসিনের লাইসেন্স করেন। তাঁর কন্যার মুখ থেকে সংগৃহীত ভাইরাসের দুর্বল স্ট্রেন আজও বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত মাম্পস ভ্যাকসিনের ভিত্তি।

৪০টির বেশি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন মার্কিন মাইক্রোবায়োলজিস্ট মরিস হিলম্যান
৪০টির বেশি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন মার্কিন মাইক্রোবায়োলজিস্ট মরিস হিলম্যান

হিলম্যানের দ্বিতীয় স্ত্রী লরিন উইটমার হিলম্যানের জীবনীকারকে বলেন, হিলম্যান ৪৭ বছর ধরে যে মার্ক নামের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কাজ করেছেন সফলতার জন্য তার কৃতিত্বও কম নয়। সেখানে গবেষণার জন্য সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। মার্কের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও ছিল প্রচুর। ফলে হিলম্যান ও তাঁর গবেষক দল মানুষ ও পশুর উপযোগী ৪০টির বেশি ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হন। হিলম্যান বেলন, মার্কে কাজের জন্য অর্থ খরচ করার সুযোগ ছিল। সেখানে অর্থ কোনো বিষয় ছিল না। নিজের গবেষণা চালিয়ে যাওয়া মূল বিষয় ছিল। তবে ওই সময় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোতে কাজের সমস্যা ছিল মানুষের সামনে কাজের স্বীকৃতি না মেলা। ওই সময় হিলম্যান ভাবতেন, তাঁর নাম পত্রিকায় এলে বা টিভিতে দেখানো হলে মানুষ ভাববে তিনি কিছু বেচার চেষ্টা করছেন। হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন কার্যকরের গবেষণাপত্রে নিজের নাম পর্যন্ত দেননি তিনি। হিলম্যান একটি আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও নিজের নাম দেননি।

শিশুদের জন্য যে ১৪টি ভ্যাকসিনের পরামর্শ দেওয়া হয়, তার আটটি হিলম্যান ও তাঁর গবেষক দলের তৈরি। এর মধ্যে মাম্পস, হাম, হেপাটাইটিস ও, বি, চিকেনপক্স, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, হেমোফেলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, হামের ভ্যাকসিনই ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ২ কোটির বেশি প্রাণ রক্ষা করেছে।

২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল তিনি মারা যান। হিলম্যানের মৃত্যুর সময়, এই ক্ষেত্রের বিজ্ঞানীরা ২০ শতকের অন্য কোনো বিজ্ঞানীর চেয়ে বেশি লোককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক অ্যান্থনি ফসি ২০০৫ সালে বলেছিলেন, ‘তাঁর একটিমাত্র আবিষ্কারই তাঁকে বিশাল সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ারের জন্য যথেষ্ট।’