ফেসবুকের লাগাম টানবে কে?

এ বিশ্বে অনেক অশান্তির মূলে ফেসবুকের ভূমিকা আছে বলে দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে। কোনো কিছুতেই ফেসবুককে বাগে আনা যাচ্ছে না। বড় বড় দেশের আইন, সে আইনের প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিয়ন্ত্রকেরা ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। প্রশ্ন উঠছে, কে লাগাম পরাবে? ঘৃণাভরা বক্তব্য আর ভুয়া খবর ছড়ানো ঠেকাতে ব্যর্থতার পরও বুক ফুলিয়ে এগিয়ে চলেছে। বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতা ছেড়ে চলে গেলেও ভয় পাচ্ছে না ফেসবুক। এত ক্ষমতার রহস্য কী? ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক ক্যারোল ক্যাডওয়ালার গার্ডিয়ানের অনলাইনে এক নিবন্ধে সে রহস্য খোলাসা করেছেন।

ক্যারোল বলছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী অনেক মানুষ ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আশ্রয় খুঁজছেন। এর মধ্যেই আবার সামনে মার্কিন নির্বাচন। ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টায় রয়েছেন অনেকেই। ফেসবুক তার দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে হাঁটছে শুধু ব্যবসা বাড়ানোর দিকেই। তাদের নীতিমালা নিয়ে শত সমালোচনা গায়ে মাখছে না। এর মধ্যে গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে গেছে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড, যার সঙ্গে সে দেশের পুলিশ জড়িত। সারা বিশ্ব যখন বর্ণবাদী আচরণের জন্য প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল, তখন সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলানোর ডাক শুনতে পায়নি ফেসবুক, বরং তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য না সরানোর পক্ষে অটল থেকেছে।

ফলে ফেসবুকের প্রতি মানুষের আস্থায় ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে। ঘৃণ্য বক্তব্যের বিরুদ্ধে ফেসবুক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ প্ল্যাটফর্ম থেকে বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতা সরে যাচ্ছেন। ফেসবুক বর্জনের ডাক দিয়ে চালু করা আন্দোলন ‘#স্টপহেটফরপ্রফিট’ জোরদার হচ্ছে। ফেসবুক থেকে বিজ্ঞাপন বর্জনের তালিকায় নাম লিখিয়েছে ইউনিলিভার, কোকা-কোলার মতো ব্র্যান্ড।

তবে ক্যারোল ক্যাডওয়ালার লিখেছেন, ফেসবুককে জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারে, এমন কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই। কোনো আইন বা নিয়ন্ত্রককে তারা পাত্তা দিচ্ছে না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্যর্থ। কুখ্যাত তথ্য কেলেঙ্কারি কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার জন্য ফেডারেল ট্রেড কমিশন যখন ফেসবুককে ৫০০ কোটি ডলার জরিমানা করল, তখন তাদের শেয়ারের দাম বেড়ে গেল। এখন ইউনিলিভার, কোকা–কোলার মতো প্রতিষ্ঠান ফেসবুকের বিজ্ঞাপন বর্জনের ডাক যদি সফল হয়, তবে মনে করতে হবে তারা ফেসবুকের দুর্বল জায়গাতে হাত দিয়েছে। আর তারা যদি ব্যর্থ হয়, তবে ধরে নিতে হবে ফেসবুক আরেকটি বড় অর্জনের দিকে যাচ্ছে।

ফেসবুকের যে পরিস্থিতি, তাতে এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেছেন, ফেসবুক তার অবস্থান বদলাবে না। ঘৃণ্য বক্তব্য নিয়ে পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞাপনদাতা ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জাকারবার্গ এ কথা বলেছেন। দ্য ইনফরমেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনদাতারা ফেসবুক ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সামনে জাকারবার্গ আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ফেসবুক বর্জনের ঘোষণার সঙ্গে সম্মানের বিষয়টিও জড়িত। এটি ফেসবুকের আয়ের সামান্য অংশে হুমকি হতে পারে। যেসব বিজ্ঞাপনদাতা সরে গেছেন, তাঁরা শিগগিরই আবার ফেসবুকে ফিরে আসবেন।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে ক্যারোল অভিযোগ করেছেন, ফেসবুক এমন একটি কোম্পানি, যারা মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য বিদেশি শক্তিকে সাহায্য করেছে। ফেসবুক সরাসরি খুনের ভিডিও সম্প্রচারের সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে গণহত্যা সংগঠনের জন্য সাহায্য করেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে ঘৃণ্য বক্তব্য ও সহিংসতা ছড়ানো হয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। এতে হাজারো মানুষ মারা গেছে এবং লাখো মানুষ জীবনভয়ে পালিয়ে গেছে।

ক্যারোলের দৃষ্টিতে ফেসবুককে তাই আয়না বলা চলে না। একে বলা চলে বন্দুক। তবে সে বন্দুক অনুমোদনহীন। এর নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশ্বের ২৬০ কোটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণহীন বন্দুক তুলে দেওয়া হয়েছে।

ক্যারোল লিখেছেন, ফেসবুকের কারণে মিয়ানমারে শত শত মানুষ হত্যা ও দেশ ছাড়ার ওই প্রতিবেদনের কথা ভাবি। যখন আমি ফেসবুকের কর্মীদের মেনলো পার্কে পিংপং খেলার ডকুমেন্টারি দেখি, তখন আরও বেশি মনে হয়। আমি যখন সিলিকন ভ্যালিতে জাকারবার্গের স্বাভাবিক জীবনযাপন দেখি তখন ভাবি, লোকটি এমন একটি কোম্পানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার হর্তাকর্তা, যা পৃথিবীর আগে কেউ কখনো দেখেনি। আমার তখন মনে পড়ে ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রিসার কথা, যিনি ফেসবুকের ক্ষতি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে জেল খাটছেন। আমার তখন চোখে ভাসে ফেসবুকের পক্ষে ব্রিটেনের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রীর নিক ক্লেগ যখন কলাম হাতে তুলে নিয়ে লেখেন, ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম নাকি সমাজের আয়না।

মানুষ অনেক সময় বলে যে ফেসবুক যদি একটা দেশ হতো তবে তা চীনের চেয়ে বড় হতো। তবে এ তুলনা ভুল। ফেসবুক যদি কোনো দেশ হতো, তবে তা হতো একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র। যেমন একে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এটা যেন বন্দুক নয়, বরং পারমাণবিক বোমা।

ফেসবুকের সমালোচনা করে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে ক্যারোল লিখেছেন, ফেসবুক কোনো কোম্পানি নয়, এটি স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, একক মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশ্ব সাম্রাজ্যের মতো। ক্ষতির প্রমাণ হিসেবে অনস্বীকার্য, অনির্বচনীয়, অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেও জাকারবার্গ কোনো কিছু কানে তোলেননি। বিশ্বজুড়ে তাঁর সমালোচকদের উপেক্ষা করবেন বলেই তিনি এমন পথ বেছে নিয়েছেন। এর বদলে এটি মূল সংবাদ বিতরণ চ্যানেলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার পরেও নিরলসভাবে, অবিশ্বাস্য, ক্রমবর্ধমান উদ্বেগমূলক অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার নাগরিকেরা যেমন দেশটির বাইরে থাকতে পারে না, ফেসবুকও তাদের হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির নিহত হওয়ার প্রতিবাদে দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফেসবুক, টুইটারে পোস্ট দেন, ‘লুটপাট শুরু হলে গুলিও শুরু হবে।’ ট্রাম্পের এই বিতর্কিত পোস্ট সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। গণ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় টুইটার কর্তৃপক্ষ ট্রাম্পের ওই পোস্ট ঢেকে দেয়। তবে ফেসবুক ট্রাম্পের ওই পোস্টের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিষয়টি নিয়ে নানা মহল যখন তীব্র সমালোচনায় মুখর, তখন জাকারবার্গ বলেছিলেন, ফেসবুক ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পোস্ট অপসারণ বা ঢেকে দেবে না। এটা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সঙ্গে যায় না।

তবে বিবিসি বলছে, সার্বিক পরিস্থিতিতে চাপে পড়েছে ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখন থেকে সম্ভাব্য ক্ষতিকর পোস্টে তারা বিশেষ লেবেল বা বার্তা লাগিয়ে দেবে। তবে সংবাদ হিসেবে গুরুত্ব থাকায় তা ছেড়ে দিতে হবে তাদের। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনাতেও সম্মত হয়েছেন জাকারবার্গ।

গার্ডিয়ান বলছে, #স্টপহেটফরপ্রফিট কর্মসূচিটি মূলত ঘৃণ্য বক্তব্য রোধ করার জন্য হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি নাগরিক অধিকার সংস্থা একত্র হয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের জুলাই মাসে ফেসবুক বর্জন করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে এটি ফেসবুকে ঘৃণ্য বক্তব্য মুছে ফেলার কর্মসূচি থেকে বড় কিছু। এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে অনেক দূর যাবে। কারণ, ফেসবুকের ক্ষতি বৈশ্বিক। গণতন্ত্রের জন্য এটি হুমকিস্বরূপ। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে থাকা তিনটি দেশের নেতৃত্ব ফেসবুকের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তাদের প্রচার যেভাবে চালাচ্ছে, তা কি কাকতলীয়? ট্রাম্প, বোলসোনারো আর বরিস জনসন? সম্ভবত নয়।

জাকারবার্গ কিম জং-উন নন। তাঁর চেয়েও শক্তিশালী। তিনি গত সপ্তাহে বলেছেন, আবার সবাই ফেসবুকে ফিরবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, বড় বড় ৫০০ কোম্পানি ফেসবুক বর্জন করলেও তা ওই প্রতিষ্ঠানের লাভে মাত্র ৫ শতাংশ প্রভাব পড়তে পারে। এতে প্রমাণ হয়, এটা চীনের চেয়ে অনেক বড়। পুঁজিবাদের চেয়ে বেশি কিছু।

ফেসবুক নিয়ে সবচেয়ে বড় কথা হলো, দিন শেষে এটি আমাদেরই পকেট কাটে। তাই আমাদের বুঝতে হবে, কেউ আমাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসবে না। দেখেশুনে মনে হয়, ট্রাম্প ও জাকারবার্গ অলিখিত একটি জোট বেঁধে ফেলেছেন। এর পাখা ছাঁটার ক্ষমতা আছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের। আর ট্রাম্পের মিথ্যা ছড়ানো ঠেকানোর উপায় আছে ফেসবুকের হাতে। আমরা কোন পথে হাঁটব?