করোনাভাইরাস: ৬ মাস পরও যেসব প্রশ্নের উত্তর অজানা

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহানে রহস্যময় একটি ঘটনা ঘটে। দ্রুত এর কারণ বের করে ফেলেন চীনা বিজ্ঞানীরা। ২০০৩ সালে চীনে যে সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল, তার মতোই একটি নতুন করোনাভাইরাস রহস্যময় আচরণ করছে বলে জানান তাঁরা। সে ঘটনার ছয় মাস পেরিয়ে ওই করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে এক কোটির বেশি মানুষকে সংক্রমিত করেছে এবং শতাব্দীর সবচেয়ে বাজে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণে ৫ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। তবে গবেষণার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটিয়েছে এ ভাইরাস। বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের গবেষকেরা এখনো কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী সার্স-কোভ-২–কে বোঝার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গত ছয় মাসে করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক, সে প্রশ্নটির উত্তর জানার কাছাকাছি পৌঁছেছেন গবেষকেরা। ভাইরাসটি কীভাবে কোষে ঢুকে তার দখল নেয়, কীভাবে কিছু মানুষ এর বিরুদ্ধে লড়তে পারে এবং কিছু মানুষ ব্যর্থ হয়, সে বিষয়ে ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন তাঁরা। মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে কোন ওষুধে বাঁচানো যেতে পারে, তা-ও শনাক্ত করে ফেলেছেন। সম্ভাব্য অনেক চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে কাজও চলছে। ভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য ১৫০ ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। এ বছরের শেষ নাগাদ হয়তো কোনো ভ্যাকসিন কার্যকর হিসেবে প্রমাণ হয়ে যেতে পারে। তবে কোভিড-১৯ নিয়ে গবেষকেরা যতটা জানছেন, ততই আরও প্রশ্ন সামনে উঠে আসছে। মারাত্মক ভাইরাসটি সম্পর্কে গবেষকদের সামনে হাজির হওয়া কয়েকটি রহস্যময় প্রশ্ন তুলে ধরেছে বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’।

করোনাভাইরাস নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রহস্যময় প্রশ্ন হচ্ছে—এটি একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম প্রতিক্রিয়া কেন দেখায়? কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি কোনো উপসর্গ দেখায় না, আবার কারও বেলায় এটি মারাত্মক উপসর্গ দেখায়। আইসল্যান্ডের জেনেটিকস নিয়ে কাজ করা ডিকোড জেনেটিকসের গবেষক কে রি স্টেফেনসন বলেন, ‘চিকিৎসার পর্যায়ে ভাইরাস সংক্রমণে মানুষের মধ্যে নাটকীয় পার্থক্য চোখে পড়ে।’ তাঁর গবেষক দল এ পার্থক্যের পেছনে জিনগত কোনো কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে। গত মাসেই আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল ইতালি ও স্পেনের এক হাজার মানুষের জিনোম নিয়ে পরীক্ষা করে কোভিড-১৯-এর সঙ্গে জিনগত সম্পর্ক থাকার প্রমাণ পেয়েছে। গবেষকেরা মনে করছেন, যাঁদের শ্বাসতন্ত্রে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়, তাঁদের বেলায় বিশেষ একটি বা দুটি জিন দায়ী থাকতে পারে।

গবেষকেরা আরেকটি প্রশ্নের উত্তর হন্যে হয়ে খুঁজছেন। করোনাপ্রতিরোধী ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ধরন কী এবং তা কতক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকে? সার্স-কোভ-২ প্রতিরোধ করতে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ সক্ষমতা খুঁজতে গবেষকেরা ‘নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি’কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এটি ভাইরাসের প্রোটিনকে আটকে রেখে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার কিছুদিনের মধ্যে নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডির স্তর বেশি থাকে, যা কয়েক সপ্তাহ পর থেকে আবার কমতে থাকে। তবে অধিক সংক্রমিত রোগীর ক্ষেত্রে আরও বেশি দিন অ্যান্টিবডি থাকতে পারে। লন্ডনের দ্য ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের গবেষক জর্জ ক্যাসিওটিস বলেন, ‘যত বেশি ভাইরাস, তত বেশি অ্যান্টিবডি এবং তত বেশি অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব।’ সার্সের ক্ষেত্রে অনেকেই কয়েক বছরের মধ্যেই অ্যান্টিবডি হারিয়েছেন। তবে অনেকেই ১২ বছর পর্যন্ত অ্যান্টিবডি ধরে রাখতে পেরেছেন।

শিশুরা কীভাবে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে? গবেষকেরা এ প্রশ্নটির উত্তরও এখন পরিষ্কারভাবে দিতে পারছেন না। সার্স-কোভ-২-এর বিরুদ্ধে লড়তে কী পরিমাণ নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি লাগবে, তাও এখনো অজানা। ইমিউনিটি অর্জনে অন্যান্য অ্যান্টিবডি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলেও মনে করছেন গবেষকেরা। কানাডার মন্ট্রিয়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আন্দ্রে এস ফিনজি বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার পরিকল্পনা করছেন। আসলে, সার্স-কোভ-২-এর বিরুদ্ধে ইমিউনিটি অর্জনে অ্যান্টিবডির বাইরেও ভাবতে হবে। অন্য ইমিউন কোষ যেমন ‘টি-সেল’ দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধী ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

গবেষকেদের কাছে এখনো ধাঁধা হয়ে রয়েছে করোনাভাইরাসের রূপ বদলের বিষয়টি। এর কি মিউটেশন হচ্ছে? মিউটেশন হলে কোন রূপটি বেশি মারাত্মক? গবেষকেরা এখন কপালে ভাঁজ ফেলার মতো কোনো করোনাভাইরাস রূপান্তর ঘটিয়েছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। মানুষকে সংক্রমণের ক্ষেত্রে সব ভাইরাসই রূপ বদল করে। সার্স-কোভ-২ ব্যতিক্রম নয়। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে। যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেভিড রবার্টসন মনে করেন, ভাইরাসটি নতুন। এটি আরও মারাত্মক রূপ নিয়েছে কি না, তা জানা জরুরি। তাঁরা এর মিউটেশন বা রূপান্তরের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন।

প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, করোনা–প্রতিরোধী ভ্যাকসিন নিয়েও। ভ্যাকসিন কার্যকর হবে তো? করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কয়েকটি ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ফল জানা গেলেও এর ভবিষ্যৎ কার্যকারিতার বিষয়টি এখনো অজানা। রূপ বদল করা ভাইরাসে ভ্যাকসিন কার্যকর হবে কি না, তা জানা প্রয়োজন হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপে ভাইরাসের মিউটেশন চোখে পড়ে। মহামারি নির্মূল করতে ভ্যাকসিনেই ভরসা মানছেন গবেষকেরা। বিশ্বজুড়ে ২০টির বেশি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চলছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা প্রাণীর দেহে ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনের ইতিবাচক ফল পাওয়ার কথা বলেছেন।

এ ধরনের গবেষণার ফল কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগে মারাত্মক রোগ প্রতিরোধের সম্ভাব্য সক্ষমতার কথা বলতে পারলেও ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ করতে পারবে না। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফল নিয়ে তথ্য খুবই সীমিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের শরীরে নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটি মানব কোষকে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। তবে কোন স্তরের অ্যান্টিবডি সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট, তা এখনো জানা যায়নি। সরকারও এ খাতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, খুব দ্রুত ভ্যাকসিন আসতে পারে। কিন্তু তার আগে এর কার্যকারিতা প্রমাণ হতে হবে।

ভাইরাসটির উৎস কী? অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, বাদুড় থেকে এর উৎপত্তি বিশেষ করে ‘হর্সসু’ বাদুড় থেকে। এ ধরনের বাদুড় দুই প্রকার মারাত্মক করোনাভাইরাস ধারণ করে যা সার্স-কোভ-২-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। একটির নাম ‘আরএটিজি ১৩’। এটি ২০১৩ সাল চীনে পাওয়া যায়। এর জিনোম সার্স-কোভ-২-এর সঙ্গে ৯৬ শতাংশ মেলে। আরেকটি হচ্ছে ‘আরএমওয়াইএন ০২’ যা মালয়ের হর্সসু বাদুড়ে পাওয়া যায়। এর সঙ্গে সার্স-কোভ-২-এর ৯৩ শতাংশ মিল পাওয়া যায়।

গবেষকেরা ১ হাজার ২০০ করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছেন, চীনের ইউনানের বাদুড় থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হতে পারে। আবার মিয়ানমার, লাওস কিংবা ভিয়েতনামের বাদুড় থেকেও আসার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেননি গবেষকেরা। গবেষকেরা এখনো এ ভাইরাসের প্রকৃত উৎসের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন।