করোনা চিকিৎসার সাফল্যে ভাসছে যুক্তরাজ্য

করোনাভাইরাসের চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাজ্য যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তার ব্যাপক প্রশংসা করছেন বিজ্ঞানীরা। একদিকে দেশটি টিকা তৈরির দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের তৈরি টিকার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে বিশ্ববাসী, অন্যদিকে কোভিডের বিরুদ্ধে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির পরীক্ষার দৌড়ে অন্য দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে যুক্তরাজ্য। সব মিলিয়ে দেশটি গবেষকেদের কাছ থেকে বিরল প্রশংসা পাচ্ছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান বলছে, যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ হার ও কেন্দ্রীয় ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) করোনার চিকিৎসাব্যবস্থা উদ্ভাবনে দেশটির গবেষকদের এগিয়ে রেখেছে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে জর্জরিত দেশগুলোকে সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি পেতে সহায়তা করছে দেশটি। যুক্তরাজ্যের গবেষকদের ‘রিকভারি টিম’ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি প্রণয়নের এ প্রশংসায় ভাসছে।

মার্কিন অর্থনীতিবিদ টেলর কোয়েনের ভাষ্য, ‘বিশ্বকে রক্ষার পথে রয়েছে ব্রিটিশরা।’ অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের বরাতে সায়েন্স সাময়িকী বলেছে, ‘দেশটির গবেষকেরা কোভিডবিরোধী কার্যক্রমের জন্য প্রশংসার যোগ্য।’ তাঁদের এ প্রশংসা মূলত ‘রিকভারি ট্রায়াল’ নামের কর্মসূচি ঘিরে। এটি যুক্তরাজ্যের গবেষকেদের গৃহীত ওষুধ পরীক্ষার বিশেষ কর্মসূচি। এতে দেশটির ১৭৬টি হাসপাতালের তিন হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবীর সঙ্গে ১২ হাজার কোভিড-১৯ রোগী যুক্ত রয়েছেন। এ পরীক্ষা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) করা হয়।

যুক্তরাজ্যের গবেষকদের বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষার ফল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সাশ্রয়ী খরচে প্রদাহ চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক মারাত্মক অসুস্থ মানুষের প্রাণ রক্ষা করা গেছে। অন্যদিকে, দুটি অধিক আলোচিত চিকিৎসাপদ্ধতি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। গার্ডিয়ান বলছে, যুক্তরাজ্য করোনা চিকিৎসাপদ্ধতির ক্ষেত্রে যে সাফল্য দেখিয়েছে, অন্য কোনো দেশ এ অর্জনের ধারেকাছেও যেতে পারেনি।

রিকভারির প্রতিষ্ঠাতা অক্সফোর্ডের গবেষক মার্টিন ল্যান্ড্রি বলেন, ‘অসাধারণ চারটি মাস গেল। এ সময়ের মধ্যে এমন কিছু হয়েছে, যার জন্য যুক্তরাজ্য গর্ব করতে পারে।’

ল্যান্ড্রি মূলত বড় আকারের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার বিশেষজ্ঞ। রিকভারির আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার হরবি সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি অক্সফোর্ডের গবেষক। হরবি বলেন, ‘ইউরোপে যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে, তখনই আমরা এখানে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করি।’

যুক্তরাজ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে, তখন ল্যান্ড্রি ও হরবি মিলে রিকভারি প্রতিষ্ঠা করেন, যার পুরো নাম র‌্যান্ডামাইজড ইভল্যুশন অব কোভিড-১৯ থেরাপি। ল্যান্ড্রি বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছিলাম হাসপাতালে যখন রোগী বাড়তে শুরু করবে, চিকিৎসকেরা তখন চিকিৎসাপদ্ধতি খুঁজবেন। আমরা দ্রুত পরীক্ষা শুরু না করলে কোন ওষুধ কাজ করবে, তা জানতে পারতাম না। এনএইচএসে করোনা রোগীর সুনামি আঘাত হানার আগে কর্মসূচি ঠিক করতে আমরা মাত্র দুই সপ্তাহ সময় পেয়েছিলাম।’

সাধারণত, চিকিৎসার কোনো প্রটোকলের জন্য প্রথম খসড়া তৈরিতেই নয় মাস লাগে। রিকভারির গবেষকেরা নয় মাসের এ কাজ নয় দিনেই শেষ করেন। মাত্র আট সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা ১০ হাজার রোগীকে পরীক্ষায় যুক্ত করেন। শুরু হয় র‌্যান্ডামাইজড ড্রাগ ট্রায়াল বা কার্যকর ওষুধ খোঁজার বিশেষ পরীক্ষা। এ ট্রায়ালে সঠিক ওষুধ খোঁজার পাশাপাশি সঠিক মান জানা যায়। এ সময় হাজার রোগীকে ওষুধ ও প্লেসেবো বা ভিন্ন ওষুধ দেওয়া হয়। কোনো রোগী জানতে পারে না সে কী ওষুধ পেল। এরপর এ পরীক্ষার ফল তুলনা করে চিকিৎসার কার্যকারিতা বের করা হয়।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, রিকভারির গবেষকেরা তাঁদের কর্মসূচি চালু করার তিন মাসের মধ্যেই ফল দেখতে পান। প্রথমে তাঁরা ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে পরীক্ষা চালান। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ কয়েকটি দেশের রাজনীতিবিদেরা এ ওষুধ নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন। কিন্তু রিকভারি টিম তাঁদের সঙ্গে একমত ছিল না। তাঁরা পরীক্ষায় দেখেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন করোনা রোগীদের কোনো সাহায্য করে না। তাদের ফল জানার পরই যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধটির জরুরি ব্যবহার বন্ধ করা হয়। এরপর আসে এইচআইভি প্রতিরোধী লোপিনাভির ও রিটোনাভিরের যৌথ চিকিৎসা। একেও করোনা প্রতিরোধে শক্তিশালী চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। রিকভারি দল ১ হাজার ৫৯৬ রোগীকে এ দুটি ওষুধ দিয়ে এবং ৩ হাজার ৩৭৬ রোগীকে প্লেসেবো দিয়ে এর ফল তুলনা করে।

এতে দুই গ্রুপের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। এ চিকিৎসাপদ্ধতিটিও আরেকটি হতাশ করা খবর ছিল। এরপরই এল ডেক্সামেথাসন নামের সস্তার একটি স্টেরয়েড ওষুধ, যা প্রদাহ ও বাতের ব্যথায় ব্যবহৃত হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, এতে ভেন্টিলেটর বা আইসিইউতে থাকা এক-তৃতীয়াংশ রোগীর মৃত্যু কমাতে পারে। এটা দারুণ একটি আবিষ্কার ছিল। ডেক্সামেথাসন ফল জানার পর বিভিন্ন হাসপাতালে মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের জন্য ডেক্সামেথাসন ব্যবহারের নির্দেশিকায় যুক্ত হয়। আর একই সঙ্গে বাদ পড়ে হাইড্রিক্লোরোকুইন, লোপিনাভির ও রিটোনাভির।

ল্যান্ড্রি বলেন, চিকিৎসকেরা ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে নানা তত্ত্ব হাজির করেন। তবে এসব তত্ত্ব প্রমাণের জন্য বড় আকারের র‌্যান্ডম বা দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করতে হয়। এতে সঠিক ফল জানা যায়। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে রিকভারি টিমের সাফল্য নানাভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশ এর প্রশংসা করছে।

বর্তমানে রিকভারির গবেষকেরা তিনটি ভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন। এগুলো হচ্ছে অ্যাজিথ্রোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক, টসিলিজুমাব অ্যান্টিবডি ও কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা। হরবি বলেছেন, ‘তাঁদের এসব পরীক্ষার ফল জানতে কয়েক মাস সময় লাগবে।’

ল্যান্ড্রি বলেন, ‘এখন যুক্তরাজ্যে হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগী কমে গেছে বলে রিকভারি টিম কম স্বেচ্ছাসেবীকে যুক্ত করতে পারছে। আগে যেখানে রোগী বেশি থাকায় দ্রুত ফল পাওয়া যাচ্ছিল। এখন ফল পেতে দেরি হবে।’