সবাই মঙ্গলে যেতে মরিয়া কেন?

গত মাসে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পরিভ্রমণের জন্য ‘আমাল’ নামের একটি যান পাঠায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। ছবি: এএফপি
গত মাসে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পরিভ্রমণের জন্য ‘আমাল’ নামের একটি যান পাঠায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। ছবি: এএফপি

চীন মঙ্গলে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই মার্স মিশন নিয়ে আছে। এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতও নিয়েছে মঙ্গলে যাওয়ার মিশন। সম্প্রতি এই তিন দেশই ‘লাল গ্রহে’ যাওয়ার টিকিট কেটেছে। কিন্তু হুট করে কেন সবাই মঙ্গলে যেতে চাইছে? শুধুই কি নিখাদ বিজ্ঞানচর্চা, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে?

ওপরের দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কে, কীভাবে মঙ্গলযাত্রার সূচনা করেছে, তার বৃত্তান্ত জানা যাক। শুরুটা করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। গত মাসে প্রথমে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পরিভ্রমণের জন্য ‘আমাল’ নামের একটি যান পাঠায় দেশটি। জাপান থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে এটি মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাতে পারবে।

এর ঠিক চার দিনের মাথায় চীন উৎক্ষেপণ করে ‘তিয়ানওয়েন-১’। মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে এই প্রথম যান পাঠাল সি চিন পিংয়ের দেশ। হাইনান প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক দ্বীপ থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় যানটি। চীনের প্যাকেজে একটি অরবিটার ও মঙ্গলপৃষ্ঠে চলার মতো উপযোগী একটি রোভার (যান) আছে। অর্থাৎ কক্ষপথে ঘুরে ছবি ও তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠদেশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে এই যান। চীনের এটিই প্রথম মঙ্গল অভিযান।

চীনের সঙ্গে ব্যাপক টক্কর চলছে ট্রাম্পের দেশের। বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে জোর কদমে। একে অন্যের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার চেষ্টাও করছে। চীন চলে যাচ্ছে মঙ্গলে, যুক্তরাষ্ট্র কি আর বসে থাকতে পারে? তাই নতুন মঙ্গলযান ‘পারসিভের‍্যান্স’ পাঠিয়েছে। এ জন্য দেওয়া হয়েছে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বাজেট। বলা হচ্ছে, ছয় পায়ের পারসিভের‍্যান্স মঙ্গলের পাথুরে জমিনে হাঁটতে পারবে স্বচ্ছন্দে। সংগ্রহ করবে নানা ধরনের নমুনা।

মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সন্ধান শুরু করছেন গবেষকেরা। ছবি: রয়টার্স
মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সন্ধান শুরু করছেন গবেষকেরা। ছবি: রয়টার্স

বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মূল লক্ষ্যই হলো পৃথিবীর বুকে দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ৫০ বছর উদ্‌যাপন। এ জন্যই পাঠানো হয়েছে মঙ্গলযান। আমালের আকার একটি ছোট গাড়ির মতো। এটি মূলত গ্রহের জলবায়ু নিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীনের তিয়ানওয়েন-১ দেশটির জন্য নতুন উচ্চতায় ওঠার সিঁড়ি। বাণিজ্যযুদ্ধ চলার মধ্যেই এসেছে করোনা মহামারি। এমন পরিস্থিতিতে চীন নিজের মর্যাদা আকাশে তোলার সুযোগ পেয়েছে এই মঙ্গলযান উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়েই মঙ্গলে যাওয়ার দিক থেকে ‘সিনিয়র’ যুক্তরাষ্ট্র পড়ে গেছে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’তে। তাতে দেশটির সাড়াও দিয়েছে ভালোমতোই। কিন্তু কথা হলো করোনার দাপটে পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত, তখন সেটা না সামলে পৃথিবী ছাড়ার দরকার পড়ল কেন?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহাকাশে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই তড়িঘড়ির পেছনে পৃথিবীতে চলা দ্বন্দ্বই কাজ করছে। আবার বর্তমান বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলতেও এমন কার্যক্রম ভালো কাজে দেয়। দুই দেশের শীর্ষ নেতাই এমন কাজে পারদর্শী বেশ।

অবশ্য এর আরেকটি দিকও আছে। এবিসি নিউজের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছেন—এটা ভালো দিক। এতে করে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই উপকৃত হবে। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্পেস পলিসি ইনস্টিটিউটের ইমেরিটাস অধ্যাপক জন লগসডন বলছেন, সব বিজ্ঞানী একে অন্যের প্রতিযোগী হয়ে উঠছেন—এটি ভালো লক্ষণ। মঙ্গলে একাধিক মিশন চালানো হলে মানুষ লাভবানই হবে।

চীন উৎক্ষেপণ করে ‘তিয়ানওয়েন-১’। মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে এই প্রথম যান পাঠাল সি চিন পিংয়ের দেশ। চীনের পাঠানো অরবিটারের একটি মডেল। ছবি: রয়টার্স
চীন উৎক্ষেপণ করে ‘তিয়ানওয়েন-১’। মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে এই প্রথম যান পাঠাল সি চিন পিংয়ের দেশ। চীনের পাঠানো অরবিটারের একটি মডেল। ছবি: রয়টার্স

মঙ্গল গ্রহ ও চাঁদের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক দিনের। পৃথিবীর বিকল্প খোঁজার চেষ্টা তো এক দিনের নয়। মঙ্গল ও চাঁদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাসস্থান নির্মাণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এ নিয়ে ঢের সায়েন্স ফিকশন গল্পগাথাও রচিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়া ও জলবায়ু অনেক আগে পৃথিবীর মতোই ছিল। এ কারণেই অন্য গ্রহে বাসস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রে মঙ্গল এগিয়ে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টেসলার এলন মাস্কের মতো শতকোটিপতিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ফলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও মঙ্গল জয়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে।

চীনের চন্দ্র অভিযানের প্রধান বিজ্ঞানী ওউইয়াং জিউয়ান। সম্প্রতি চীনা সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই মানুষ স্থানান্তরের জন্য দ্বিতীয় গ্রহ খুঁজছেন। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীর মনুষ্য প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিকল্প আবাসস্থল গড়ে তোলা। বর্তমানে সম্ভাবনা হিসেবে হাতে আছে কেবল মঙ্গল গ্রহ।

তবে এলন মাস্কের মতো উদ্যোক্তা ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অন্য গ্রহে মানুষের ‘কলোনি’ তৈরির ক্ষেত্রে সবাই আশাবাদী হচ্ছে না। যারা মঙ্গলে কলোনি স্থাপনের বিষয়ে বেশি আগ্রহী, তারা বলছে, মনুষ্য প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতেই এটি প্রয়োজন। কিন্তু নিন্দুকেরা বলছে, এভাবে অন্য গ্রহে কলোনি তৈরির দিকে না ঝুঁকে বরং পৃথিবীর বর্তমান সমস্যাগুলো মোকাবিলায় অর্থ খরচ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। সমালোচকদের অভিযোগ, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য সমস্যা না রুখে অবিবেচকের মতো অন্য গ্রহে কলোনি তৈরির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালার কোনো মানে নেই।

মঙ্গলযান পারসিভের‍্যান্স। ছবি: রয়টার্স
মঙ্গলযান পারসিভের‍্যান্স। ছবি: রয়টার্স

‘জ্যাকোবিন’ ম্যাগাজিনে চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মঙ্গল বা অন্য কোনো গ্রহে মানুষের কলোনি নির্মিত হলে তাতে সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হবে না। এটি তৈরিই হবে শুধু ধনী মানুষের জন্য। কারণ, এসব প্রকল্পে অর্থ ঢালছে ধনী ও প্রভাবশালীরা। হয়তো শুরুতে কিছু সাধারণ মানুষকে নেওয়া হবে, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা পরিণত হবে প্রজায়। সেটি হবে শুধুই রাজাদের স্বর্গ।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মহাকাশে কলোনি নির্মিত হলে সেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতাও খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ‘ডার্ক স্কাইজ: স্পেস এক্সপানশনিসম, প্ল্যানেটারি জিওপলিটিকস অ্যান্ড দ্য এন্ডস অব হিউম্যানিটি’ নামক বইয়ের রচয়িতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ডিউডনি বলছেন, মহাকাশে বসতি স্থাপন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়। নতুন গ্রহে তৈরি কলোনিতে সমষ্টিতে বিলীন হয়ে যাবে ব্যক্তি। সুতরাং ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলে মঙ্গলে ঘরবাড়ি বানানোয় সমর্থন না দেওয়াই ভালো হবে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে মঙ্গল গ্রহে রোভার যানের নামার দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স
শিল্পীর দৃষ্টিতে মঙ্গল গ্রহে রোভার যানের নামার দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স

মঙ্গলে আদৌ মানুষ বসতি স্থাপন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ভবিষ্যৎই জানাবে মানুষ দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধান পাবে কি না। তবে এ নিয়ে এখনই যেসব প্রশ্নের তির উঠতে শুরু করেছে, সেগুলোর যৌক্তিক সমাধান করে একটি সম্মিলিত প্রয়াস সৃষ্টি করাও প্রয়োজন। তবেই হয়তো মানুষের মহাকাশ অভিযাত্রা সত্যিকারের সফলতা পাবে।