ভাইরাস ভাইরাস খেলা

ভাইরাস
ভাইরাস

‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র প্রবাদটা তো আর এমনি এমনিই আসেনি। যেমন আসেনি ‘বিষে বিষক্ষয়’ প্রবাদটা! পুরোনো যুগে পোকামাকড়ের বিষ নামাতে বিষাক্ত আর কষযুক্ত ঔষধি গাছের ব্যবহার ছিল। সেই চিকিৎসা এখনো আছে। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস থেকেও তৈরি হচ্ছে মরণব্যাধির ওষুধ। তাহলে আর প্রযুক্তিবিদদেরই দোষ দেবেন কেন? কম্পিউটারের জগতে বসে তারাও তো ওই একই কাজ করছে; কম্পিউটারের ভাইরাস মারছে ‘ভাইরাস’ দিয়েই!
শুধু শুধুই ‘বাগ’ কিংবা ‘ওয়ার্ম’-এর নাম শুনে চোখ কপালে তুলছেন কেন? তথ্যপ্রযুক্তির এই কীটপতঙ্গগুলো নিয়ে তো স্কুল পড়ুয়ারাও ইদানীং বিচলিত হয় না; বরং ‘ভাইরাস’ নামে পরিচিত এই ঝুট-ঝামেলাগুলোকে একরকম থোড়াই কেয়ার করে বাচ্চাগুলো। সময়ই ওদের শিখিয়েছে কম্পিউটারের ভাইরাস কী।
তথ্যপ্রযুক্তির পুরোনো যুগের বিশেষজ্ঞরা দুনিয়াজুড়ে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে, নিজের দিকে নজর কাড়তেন। কেউ আবার ‘এমনি এমনিই’ ভাইরাস ছুড়ে দিয়ে মজা নিতেন। ইদানীং বলা হচ্ছে, ‘ভাইরাস’ এখন ব্যবসা! এই সময়ে কম্পিউটার প্রযুক্তির ওস্তাদেরা ভাইরাস বানান কড়া নিরাপত্তায় রাখা প্রতিপক্ষ বা শত্রুর তথ্যগুলো চুরি করতে! অথবা বড় কোনো কোম্পানিকে বিপাকে ফেলে তার কাছ থেকে টু-পাইস কামিয়ে নিতে!
কিছুদিন ধরে দুনিয়ার দুই শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একে অন্যকে নিজেদের গোপন তথ্যে হানা দেওয়া, অনুপ্রবেশ, তথ্য চুরি বা গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে অভিযুক্ত করছে, সেটারও ভিত্তি এই ভাইরাসই। মার্কিনরা বলছে, রাশিয়া তাদের পেন্টাগনের মতো কড়া নিরাপত্তায় থাকা তথ্যে উঁকিঝুঁকি মারছে। রাশিয়ারও একই অভিযোগ মার্কিনদের ওপর!

ভাইরাস যখন ব্যবসা!
তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইন্টারনেট নাকি যুদ্ধক্ষেত্র। তাঁদের মতে, সাইবার যুদ্ধ এখন আর ভবিষ্যৎ নয়, বরং এটা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গেছে এবং চলছে। তাঁদের মতে, ইন্টারনেট রণক্ষেত্র হলে ভাইরাস তার অস্ত্র। আর হ্যাকাররা সেই অস্ত্র হাতে সৈনিক, কখনো অস্ত্রের কারবারি।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিন একটি মূল প্রতিবেদনে পোর্টনয় নামে একজনের নাম ছেপেছে। সফটওয়্যার নিয়ে তাঁর কাজ-কারবার। বয়সে তরুণ। খুব ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি তাঁর স্কুলের নেটওয়ার্ক হ্যাক করে সব শিক্ষার্থীর তথ্য, তাদের পরীক্ষার ফলাফল ইত্যাদি ঘাঁটতে পারতেন। এমনকি নিজেরটাও! তাঁর বিশ্বাস, ভাইরাস হলো এ মুহূর্তে টাকা কামানোর সবচেয়ে ভালো পণ্য। তাঁর মতে, মানুষের কাজ এখন তথ্য নিয়ে। হয় তাঁর নিজের তথ্য নিরাপদে রাখা অথবা অন্যের তথ্য চুরি ও ধ্বংস করা। তিনি বলছেন, এখন বেশির ভাগ মানুষই তথ্য খুঁজছে। যারা খুঁজছে তারা হয় গোয়েন্দা সংস্থার কেউ, নয়তো ভয়ংকর অপরাধী। বেশির ভাগই এখন ভাইরাস দিয়ে অন্যের ক্ষতি করার জন্য নয়, বরং অন্যের গোপন তথ্য চুরির জন্য পয়সা ঢালে। আলোচিত গোয়েন্দা কর্তা স্নোডেনের ফাঁস করে দেওয়া তথ্যে পাওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই ভাইরাস ভাইরাস খেলার জন্য প্রায় আড়াই কোটি ডলার খরচ করেছে।
একসময় শুধু শখের বশে স্কুলের নেটওয়ার্কের বারোটা বাজানো পোর্টনয় এখন পুরোদস্তুর পেশাদার। তাঁর মতে, ভাইরাস বেচাকেনার বাজার যে কত, সেটা কল্পনারও বাইরে। আমরা সেই ভাইরাস নিয়েই ব্যবসা করি। নিজেরা ভাইরাস তৈরি করে খড়গের নিচে না পড়ে বরং অন্যের ভাইরাসকে নষ্ট করার দায়িত্ব নেন। আর সে কারণেই তার দুই বছরের প্রতিষ্ঠান এক্সোডাস ইন্টেলিজেন্সের স্লোগানটা এমন, ‘আমাদের মতো খারাপ লোকের হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোই আমাদের ব্যবসা!’

ভাইরাস
ভাইরাস

ভাইরাস চক্র
প্রতিটি সফটওয়্যারেই কিছু ত্রুটি বা ফাঁক থাকে। আর যদি আপনি সেটা খুঁজে বের করতে পারেন, তবে? সেই ত্রুটি বা বাগ আপনি শুধরে দিতে সহযোগিতা করতে পারেন অথবা বিক্রি করতে পারেন!
প্রথম কাজ হলো সফটওয়্যারটা বিশ্লেষণ করা। একটি সফটওয়্যারের কোথায় কোন খুঁত আছে, সেটা বের করাটা যেনতেন লোকের কাজ নয়। মানসম্মত সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞই হতে হবে তার জন্য। এও মনে রাখতে হবে, এমন ভুল খুঁজছেন, যা কিনা ওই সফটওয়্যারের নির্মাতা চোখও এড়িয়ে গেছে!
দ্বিতীয় ধাপে তেমন সফটওয়্যার খুঁজে বের করতে হবে, যেটায় নিরাপত্তা ত্রুটি আছে এবং এমন নিরাপত্তা সমস্যা, যা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি।
এরপর ওই সফটওয়্যারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন কি না, সেটা গুরুত্ব বহন করে। যদি পারেন তবে আপনার সামনে বেশ কটি রাস্তা খুলে যায়। দেনদরবার করতে সুবিধা হয়, অংশীদারদের সঙ্গে!

কারা তারা?
সফটওয়্যার নির্মাতা। যারা ওই সফটওয়্যার নির্মাণ করেছে তাদের কাছেই তুলে ধরা যায় ওই দুর্বলতা বা খুঁতগুলো।
সরকার। সংশ্লিষ্ট সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাও এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায় কখনো কখনো। দরকার পড়লে তারা অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারও কেনে।
অপরাধী। ভাইরাস শুধু খোলাবাজারেই নয়, বরং বিক্রি হয় কালোবাজারেও। সেখানে ওত পেতে থাকে অপরাধীরা। তারাও কিছু প্রতিষ্ঠানকে ফাঁসানোর জন্য ভাইরাস কেনে।
ভিন্ন কোনো দেশ। যেহেতু এই বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই ভাইরাস শুধুই একটি দেশে নয় বরং অন্য দেশেও কেনাবেচা হয়।
খুব জনপ্রিয় সফটওয়্যারের খুঁত বা দুর্বলতার খোঁজ পেলে রাতারাতিই হিরো বনে যাওয়া যায়। পরিচিতির পাশাপাশি মিলতে পারে মোটা অঙ্কের টাকাও।

ভয়ংকর কিছু আক্রমণ
স্টাক্সনেট ২০০৯
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তৈরি করেছিল এই বাগ। মূলত উইন্ডোজ ব্যবহার করা ইরানের নিউক্লিয়ার প্রকল্পের দুর্বলতার খোঁজখবর নিতেই। তবে তাতে ক্ষতি হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের।
অরোরা ২০০৯
সফটওয়্যারটি তৈরি করেছিল চীনা হ্যাকাররা।
ব্ল্যাকহেড ২০১০-১৩
রুশ হ্যাকাররা ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, ফ্ল্যাশ আর জাভা ব্যবহারকারীদের আক্রমণ করেছিল। লক্ষ্য ছিল সারা দুনিয়ার সব কম্পিউটার। এটা বিক্রি হয়েছিল কালোবাজারে।
সূত্র: টাইম। ২১ জুলাই ২০১৪ সংখ্যা

সাম্প্রতিক বছরের কিছু ঘটনা
উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যেসব হ্যাকার নির্মাতা মাইক্রোসফটকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেছে, তাদের পয়সা দিয়ে পকেটে পুরে রেখে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ এক লাখ ডলার খরচ করতে হয়েছে হ্যাকারদের পেছনে।
২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিজেদের ফায়ারফক্স সেবাটির দুর্বলতার জন্য মজিলা খরচ করেছে ১৫ লাখ ডলার।
২০১৩ সালে মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক গড়ে দুই হাজার ২০৪ ডলার করে দিয়েছে প্রতিটি ত্রুটি বা দুর্বলতা খুঁজে দেওয়ার জন্য। তবে একটা বিশেষ বিপদে পড়ে একজন ব্রাজিলীয় হ্যাকারকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩৩ হাজার ডলারও দিতে হয়েছে জাকারবার্গকে।
২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত গুগল তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হ্যাকারদের ৩৩ লাখ ডলার উপঢৌকন দিয়েছে। সফটওয়্যারে খুঁত এবং তাতে কত বড়ÿক্ষতি হতে পারে, সেই বিবেচনায় দেনদরবারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। গুগল এ ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত দিয়েছে একেকজনকে। একটা বড় ফ্যাসাদে পড়ে তাদের খরচ করতে হয়েছিল দেড় লাখ ডলার!