অনন্য মহাজাগতিক দৃশ্য

ধূমকেতু সাইডিং স্প্রিং গত রোববার মঙ্গল গ্রহের খুব কাছ ঘেঁষে অতিক্রম করে। এ সময় নাসার তিনটি মহাকাশযান ধূমকেতুটির লেজের বর্জ্য থেকে নিজেদের আড়াল করতে এভাবেই গ্রহটির অপর পাশে অবস্থান নেয় l ছবি: নাসা
ধূমকেতু সাইডিং স্প্রিং গত রোববার মঙ্গল গ্রহের খুব কাছ ঘেঁষে অতিক্রম করে। এ সময় নাসার তিনটি মহাকাশযান ধূমকেতুটির লেজের বর্জ্য থেকে নিজেদের আড়াল করতে এভাবেই গ্রহটির অপর পাশে অবস্থান নেয় l ছবি: নাসা

মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য মহাজাগতিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন মহাকাশবিজ্ঞানীরা। গত রোববার রাতে সৌরজগতের অন্যতম গ্রহ মঙ্গলের খুব কাছ দিয়ে একটি ধূমকেতু পরিভ্রমণ করে।
‘সাইডিং স্প্রিং’ নামের এই ধূমকেতু লাল গ্রহ মঙ্গলের এত কাছ দিয়ে অতিক্রম করেছে যে মহাজাগতিক হিসাবে বিজ্ঞানীদের কাছে তা চুল পরিমাণ দূরত্ব। মঙ্গল থেকে ধূমকেতুটির দূরত্ব ছিল মাত্র ৮৭ হাজার মাইল, যা পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্বের তিন ভাগের এক ভাগ।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস মানমন্দিরের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গত বছরের জানুয়ারিতে এই ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘সাইডিং স্প্রিং’। তবে এটি ‘সি/২০১৩ এ১’ নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধূমকেতুটি মহাবিশ্বের ‘ওর্ট ক্লাউড’ অঞ্চল থেকে আগত। ‘ওর্ট ক্লাউড’ আমাদের সৌরজগতের অনেক দূরে অবস্থিত একটি এলাকা।
বরফ ও নিউক্লিয়াস-সমৃদ্ধ এই ধূমকেতুর ব্যাস মাত্র এক কিলোমিটারের মতো। মঙ্গলে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান অরবিটারে তোলা ছবি পাওয়া গেলে ধূমকেতুটির সঠিক আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হবে। সাড়ে চার শ বছর আগে এটি গঠিত হয়েছে। গঠনের পর এটি খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে। তাই এই ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করে সাড়ে চার শ বছর আগে আমাদের সৌরজগতের অবস্থা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কারণ: বিজ্ঞানীদের কাছে এই মুহূর্তটি খুবই আগ্রহোদ্দীপক। কারণ এই প্রথম বিজ্ঞানীরা এত কাছ থেকে সৌরজগতের বাইরের কোনো ধূমকেতুকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড্যান ব্রাউন বলেন, ‘মঙ্গলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করা ধূমকেতুর বিষয়ে উৎসাহের কারণ হলো, মহাকাশে এখন অনেকগুলো মহাকাশযান অবস্থান করছে এবং সেগুলো একসঙ্গে কাজ করছে।’
অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিচেল ব্রাউনও একই কথা বলেন। তাঁর মতে, এমন ঘটনা খুবই দুর্লভ। তবে এটা সৌভাগ্যের বিষয় যে ধূমকেতুটি অতিক্রমের সময় মনুষ্যনির্মিত অনেকগুলো মহাকাশযান সেখানে ছিল। সেগুলোর সাহায্যে ধূমকেতুটির ছবি তোলা সম্ভব হবে, যা মহাকাশ গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে মঙ্গলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের কয়েকটি মহাকাশযান অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, মঙ্গলে তাদের পাঠানো অরবিটার, ম্যাভেন ও ওডেসি নামের তিনটি মহাকাশযান ধূমকেতুর প্রভাব এবং এর লেজ থেকে নির্গত আবর্জনা থেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। তবে ধূমকেতুটি মঙ্গল অতিক্রমের সময় সেগুলো গ্রহটির অপর পাশে থাকায় কোনো বিপত্তি ঘটেনি।
মঙ্গল গ্রহ অতিক্রমের সময় উন্নত ক্যামেরা এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি-সংবলিত মহাকাশযানগুলো সফলভাবে ধূমকেতুটিকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া ধূমকেতুটির লেজ থেকে নির্গত আবর্জনা এবং মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে এর প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করাও সক্ষম হবে।
নাসা জানিয়েছে, মঙ্গলে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান অরবিটার ধূমকেতুটির ছবি তুলবে। অপর একটি মহাকাশযান ধূমকেতুটি থেকে নির্গত সংকেত থেকে এর গ্যাস ও আবর্জনার আচ্ছাদন নিয়ে বিশ্লেষণ করবে। কিউরিসিটি ও অপরচুনিটি নামের মহাকাশযান দুটি মহাকাশে নিরাপদ অবস্থানে থেকে ‘সাইডিং স্প্রিং’-এর ছবি তুলতে সমর্থ হয়েছে।
সাইডিং স্প্রিংয়ের ঝুঁকি: সাইডিং স্প্রিং ধূমকেতুটি সূর্যের পরিভ্রমণ পথের দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে। এই ধূমকেতুটির গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। জানামতে, এর আগের সবচেয়ে দ্রুতগতির ধূমকেতুটির গতি ছিল সেকেন্ডে ১৫ কিলোমিটার। আর সাইডিং স্প্রিংয়ের গতি তার চেয়েও চার গুণ বেশি।
ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেসিকা সানসাইনের মতে, ‘এই গতির ধূমকেতুর ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। কারণ, মাত্র কয়েক মাস আগে এই ধূমকেতু সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এটা যদি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসত, তবে আমরা কিছুই করতে পারতাম না।’
সূত্র: বিবিসি ও গার্ডিয়ান।